বরগুনার পাথরঘাটায় ২০০৭ সালে নিজের ভিটায় খুন হন দেবরঞ্জন কির্ত্তনীয়া (৭০)। জমিজিরাত নিয়ে শরিকদের মধ্যে গন্ডগোল চলছিল। মামলার এজাহার অনুযায়ী, এক পক্ষের সঙ্গে হাত মেলান হারুন–অর–রশিদ। তারপর কুপিয়ে হত্যা করেন দেবরঞ্জনকে। এই হারুন–অর–রশিদই এখন জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি নামের একটি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান জিয়াউল আমিন।
মানবাধিকার সংস্থার সাইনবোর্ডের আড়ালে দেশের ৪০টি জায়গায় কমিটি বানিয়ে জায়গাজমি, পারিবারিক সমস্যা মেটানো বা চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যদিও ২০১৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ সংস্থার অনুমোদন বাতিল করেছে। হারুনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেও সুবিচার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী মানুষ। উল্টো কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করছেন হারুন।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর বাসিন্দা নুরুন্নবী প্রতারণার শিকার হয়ে এলাকাছাড়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে নাগেশ্বরীতে জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি একটা অফিস খোলে। খবর পেয়ে নুরুন্নবীর বাবা নূর মোহাম্মদ দেখা করেন সংস্থার লোকজনের সঙ্গে। নুরুন্নবী তখন মিরপুরে দরজির কাজ করতেন। একদিন তাঁর বাবা ফোনে জানান, ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন ওই সংস্থাকে, কিন্তু জায়গাজমির ঝামেলা মিটছে না। চেয়ারম্যান হারুন–অর–রশিদ ওরফে জিয়াউল আমিনের সঙ্গে মোহাম্মদপুরে গিয়ে দেখা করেন নুরুন্নবী। জিয়াউল আমিন তাঁকে সংস্থায় যোগ দিতে বলেন, ৪১ সদস্যের একটা কমিটিও গঠন করতে বলেন। দুই হাজার টাকার বিনিময়ে প্রত্যেককে তিনি সংস্থার একটি কার্ড করে দেন। বলেন, দলে ভারী হলে জমিজায়গা সম্পর্কিত মামলা–মোকদ্দমা লড়তে সুবিধা হবে। এরপর নুরুন্নবীকে তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। লাখ পাঁচেক টাকা দিলে তিনি যে কাউকে চাকরি দিয়ে দেবেন। নুরুন্নবী আর কাউকে না বলে গ্রামে বেকার চাচাতো ভাইকে নিয়ে এলেন। পাঁচ লাখ টাকা দিলেও সে চাকরি আর হয়নি।
কেরানীগঞ্জে নিজামউদ্দীন নামে প্রতারণার শিকার আরেক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, বছর চারেক আগে তাঁর ভগ্নিপতি বোনকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তিনি জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটিতে গিয়ে সাহায্য চান। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চিঠি লিখে সংসারটা জোড়া দিয়ে দেবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে হারুন–অর–রশিদ ৬০ হাজার টাকা নেন। সমস্যার সমাধান হয়নি। নিজামের ভগ্নিপতি তাঁর (নিজাম) ও তাঁর মাসহ সাতজনের নামে ডাকাতির মামলা করে দেন। পরে তিনি জানতে পারেন, হারুনই তাঁর ভগ্নিপতিকে দিয়ে মামলাটা করেন।
>নাম বদলে জাতীয় মানবাধিকার ইউনিটি নামে মানবাধিকার সংস্থা খুলেছেন জিয়াউল আমিন। অনুমোদন না থাকলেও ৪০টি শাখা খুলেছেন।
কুড়িগ্রামেরই এক শিক্ষক মো লাভলু খোয়ান ৫০ হাজার টাকা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হারুন–অর–রশিদ এলাকায় এসে জানান, দুই হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সংস্থার এক বছরের সদস্যপদ দেবেন। কেউ স্থায়ী সদস্য হতে চাইলে ৪০ হাজার টাকা লাগবে। যেকোনো সরকারি অফিস ওই কার্ড দেখলেই তদবির শুনতে বাধ্য। এসব কথা শুনে মো. লাভলু কার্ড করেছিলেন। পারিবারিক সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলে হারুন–অর–রশিদকে তিনি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, বরগুনার পাথরঘাটায় ২০০৭ সালে দেবরঞ্জন কির্ত্তনীয়া হত্যা মামলার আসামি হিসেবে অল্প কিছুদিন জেল খাটেন। জামিনে মুক্তির পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। প্রথম আলোর বরিশাল প্রতিনিধি জসিমউদ্দীন খোঁজখবর নিয়ে জানান, এলাকার লোকজন তাঁকে ‘টাউট–বাটপার’ হিসেবেই জানেন। তিনি নানা জনের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে হয়রানি করতেন, মামলাও করাতেন। মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, টিআইবির ইফতেখারুজ্জামানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে তিনি নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি পাঠান।
অভিযোগ সম্পর্কে হারুন–অর–রশিদ ওরফে জিয়াউল আমিন মুঠোফোনে বলেন, তাঁর সংস্থার অনুমোদন আছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। হারুন–অর–রশিদ নাম ঢাকায় এসে বদলে ফেলেছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডকুমেন্টে এই নাম। মানুষের একটার বেশি নাম থাকতে পারে না?’ আর হত্যা মামলা প্রসঙ্গে বলেন, ওই মামলাটি শত্রুতা করে করা।
হারুন–অর–রশিদ ওরফে জিয়াউল আমিনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন ব্যক্তিরা নিজেই তাঁদের মতো ১৭ জন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন। অন্তত পাঁচজন প্রথম আলোকে বলেছেন, কোনো না কোনোভাবে হারুন তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।