কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সুন্দরবন নামে পরিচিত প্যারাবনের দেড় হাজার একর জায়গার গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে একাধিক চিংড়িঘের। গত ১৫ দিনে সুন্দরবনের চরণদ্বীপ মৌজার রামপুর, চরণদ্বীপ, চিলখালি, গোলদিয়া প্যারাবনের এক লাখের বেশি বাইন, কেওড়া, গেওয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এখন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের পাহারা বসিয়ে সেখানে তৈরি হচ্ছে চিংড়িঘের। এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়ছে উপকূলের অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ।
বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ জাতীয় এই প্যারাবন চকরিয়ার সুন্দরবন নামে খ্যাত ছিল। উপজেলার রামপুর মৌজায় এর অবস্থান। জীববৈচিত্র্যেও বনটি ছিল সমৃদ্ধ। তবে ৭০ ও ৮০র দশকে চিংড়িঘের তৈরির পর থেকে এই প্যারাবনটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। সুন্দরবন রেঞ্জের ২১ হাজার ৮৯০ হেক্টরের মধ্যে অধিকাংশ স্থানেই চিংড়িঘের তৈরি হয়েছে।
১৯৯১ সালের প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে এই বন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সবুজ বেষ্টনী না থাকায় ওই ঝড়ে উপজেলার ৪৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর বনের রামপুর, চরণদ্বীপ, চিলখালি ও গোলদিয়া এলাকায় নতুন করে প্যারাবন সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সব এলাকায় ফের চিংড়িঘের গড়ে উঠেছে। বর্তমানে অবৈধভাবে দেড় হাজার একর প্যারাবন দখল করে একাধিক চিংড়িঘের তৈরি হয়েছে।
চকরিয়ার গোলদিয়া ও চিলখালি এলাকাটি বনদস্যুদের একরকম স্বর্গরাজ্য বলে জানা গেছে। দুর্গম ওই এলাকায় বনদস্যুরা সশস্ত্র পাহারা বসানোয় বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরাও যেতে সাহস করেন না।
কক্সবাজার শহর থেকে নৌপথে গোলদিয়া ও চিলখালির দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। চকরিয়া উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন গোলদিয়ারচর ও চিলখালির চরে সড়কপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। স্পিডবোট কিংবা ট্রলার নিয়ে সেখানে ভিড়তে চাইলে সন্ত্রাসীরা বাধা দেয়। সন্ধ্যার পর ফাঁকা গুলি চালিয়ে জেলে ও সাধারণ মানুষকে ভয় দেখায় বলে অভিযোগ আছে।
গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, গোলদিয়া ও চরণদিয়া প্যারাবনে চিংড়িঘের নির্মাণের মহোৎসব চলছে। অসংখ্য শ্রমিক দিয়ে প্যারাবন নিধন ও ঘেরের বাঁধ তৈরি হচ্ছে। অস্ত্রধারী লোকজন বাঁধে দাঁড়িয়ে পাহারা বসিয়েছেন।।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার কয়েকজন মৎস্যজীবী বলেন, চকরিয়ার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি প্যারাবনের গাছ নিধন করে চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের ব্যস্ততার সুযোগ নিচ্ছেন তাঁরা। দিনের চাইতে রাতেই কাটা হচ্ছে বেশি গাছ। গত ১৫ দিনে দেড় হাজার একর প্যারাবনের ১ লাখ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানান তাঁরা। সেই গাছ চকরিয়ার বিভিন্ন ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ কিংবা উপজেলা ভূমি অফিসের কেউ সেখানে যাননি। এতে আরও অনেকে প্যারাবন উজাড়ে উৎসাহিত হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী গাছগুলো কাটা হয় করাত দিয়ে। আর ছোট গাছের প্যারাবনে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা গোলাম মুর্তজার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার বলেন, ‘প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরির অভিযোগ পেয়েছি। সরেজমিনে গিয়ে ঘটনার বিষয়টি জানানোর জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালককে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, দুর্গম ওই চরে নৌপথে যেতে হয়। চকরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ১৮ মার্চ। নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি ও পুলিশ ব্যস্ত থাকায় ঘটনাস্থলে যাওয়া হচ্ছে না। পুলিশ ছাড়া একাকী পরিবেশ অধিদপ্তর দলের সেখানে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।