সিনহা হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন

পুলিশের কর্মকাণ্ড ছিল হঠকারী, অপেশাদারি

■ আইনি বিধানের অপপ্রয়োগ করে ব্যক্তিবিশেষ দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হন।

■ লিয়াকতের গুলিবর্ষণ সেটারই ফল।

■ ওসি প্রদীপের ঔদ্ধত্য ছিল সীমাহীন।

সিনহা মো. রাশেদ খান

কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনাটি তাৎক্ষণিক নাকি পরিকল্পিত—এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই গুলিবর্ষণ নিছক আত্মরক্ষার জন্য ছিল, না নেপথ্যে অন্য কোনো রহস্য আছে, বিষয়টি কমিটিকে ভাবিয়ে তুলেছে।

সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পুলিশের হঠকারী (অবিমৃশ্যকারী), প্রস্তুতিহীন ও অপেশাদারি আচরণ বলে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি বলেছে, যথাযথ তদারকি ও জবাবদিহির অভাবে গুলিবর্ষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মনে অসংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনি সুবিধার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এসব বন্ধে কমিটি ১৩ দফা সুপারিশও করেছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গত সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমিটির সদস্য লে. কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহান আলী ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক জাকির হোসেন খান।

তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি পুলিশি তদন্তের বিষয়। কমিটি তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন সচিব এটা বিশ্লেষণ করে দেখবেন। পরবর্তী সময়ে আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছ পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে কিছু ঘটনাকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো, পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতকে মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিনের আটবার ফোন দেওয়া, কোনো রকম যাচাই না করে ডাকাত ধরার অবিশ্বাস্য প্রস্তুতিহীন অভিযান পরিচালনা, গুলি করার স্পষ্ট কোনো কারণ না থাকার পরও গুলি করা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুলিবিদ্ধ সিনহাকে ওসি প্রদীপের আঘাত করা, আহত সিনহাকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ফেলে রাখা, ট্রাকে করে হাসপাতালে পাঠানো ও নিহত সিনহাকে আসামি করে ইয়াবা ও খুনের মামলা দেওয়া।

আগে যা ঘটেছিল

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে নয়টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (শিফাত) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে পুলিশ আটক করে। পরে নুরকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।

এ ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁরা এটাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।

দুই বাহিনীর প্রধান যেদিন বিষয়টি ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেদিনই ঢাকায় রাওয়া ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন। সংগঠনের সদস্যরা সিনহা হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামারও হুমকি দেন। এরপর বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, থানার ওসিদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন এবং রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেওয়া হয়।

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে বাকি তিনটি মামলা করে। পুলিশের মামলায় নিহত সিনহাকেও আসামি করা হয়। এর কয়েক দিন পর হত্যা মামলা করেন নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলাই তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। পরে র‌্যাব এ ঘটনায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১০ পুলিশ সদস্য এবং নিহত হওয়ার আগে সিনহা যে পাহাড়ে গিয়েছিলেন, সেই গ্রামের তিন বাসিন্দাকে গ্রেপ্তার করে। এঁদের মধ্যে প্রদীপ ছাড়া পাঁচ পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় তিন ব্যক্তি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। চার আসামি এখনো রিমান্ডে আছেন। ওসি প্রদীপসহ নয়জন আসামি কারাগারে।

তদন্ত কমিটি

সিনহা হত্যার তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর মধ্যে প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে দীর্ঘ জেরা করে। কমিটির সদস্যরা দুই দফা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গত সোমবার কমিটি ৮০ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনসহ ৫৮৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাখিল করে।

১১ প্রশ্নের জবাব খোঁজে কমিটি

ঘটনার উৎস ও কারণ উদ্‌ঘাটনসহ ১১টি বিষয় হাতে নিয়ে তদন্ত নেমেছিল এই কমিটি। কমিটির কাছে প্রশ্ন ছিল, কোন তথ্যের ভিত্তিতে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী তল্লাশিচৌকিতে অবস্থান নিলেন? তিনি কি প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করেছিলেন? তদন্তকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে তিনি অন্য সংস্থার সহযোগিতা ও যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি না? ঘটনাস্থলে সিনহা ছাড়া অন্য কারও প্রাণ সংহারের আশঙ্কা ছিল কি না? এই গুলিবর্ষণ কি শুধুই আত্মরক্ষা? গুলিবর্ষণ কি এড়ানো যেত না? এটা কি পূর্বপরিকল্পিত? সিনহার কোনো কাজ কি গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী? লিয়াকত কি ঘটনার পর প্রকৃত ঘটনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন? গুলির পরে কর্তা-ব্যক্তিদের ভূমিকাই বা কেমন ছিল? সব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব বের করতে পারেনি কমিটি। প্রতিবেদনে সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটি যা পারেনি

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তের জন্য কমিটি পর্যাপ্ত সময় পায়নি। যদিও কমিটি গঠনের তিন দফা সময় বাড়ানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর (অব.) সিনহার অস্ত্রটি নিয়ম অনুসারে জব্দ না করায় ফরেনসিক পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

সিনহার সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভেতরে গরমিল থাকার ব্যাপারে কমিটি কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিতে পারেনি। টেকনাফ থানার কোনো সিসিটিভির ফুটেজও হাতে পায়নি কমিটি। র‌্যাবের তদন্তের কারণে সাক্ষীদের ঠিক সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল ফোনের তালিকা (সিডিআর) ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেনি। হোয়াটসআপ, সিগন্যাল ও টেলিগ্রামের কোনো কল রেকর্ড পায়নি কমিটি।

এ​ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, অল্প সময়ের কারণে এতে হয়তো সবকিছু তুলে আনা সম্ভব হয় না। কিন্তু এ ধরনের প্রতিবেদন একটি গাইডলাইন হিসেবে কাজ করে। তদন্তকারীদের ওপর এতে একটা চাপও তৈরি হয়। তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অব্যাহত আছে। সেখানে তদন্তকারী পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাবেন, তার ভিত্তিতেই অভিযোগপত্র দেবেন। এরপর বিচার সম্পন্ন হবে। সেই সময় বিচারক চাইলে এই প্রতিবেদন দেখতে পারেন।

শুরুতেই ভুল খবর

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিনহা সঙ্গী সিফাতকে নিয়ে মারিশবুনিয়ার টুইন্যার পাহাড়ে ‘টাইম ল্যাপস’ ভিডিও করতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর পাহাড়ে আলো দেখে স্থানীয় কয়েকজন তাঁদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন। তদন্ত কমিটির কাছে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত বলেছেন, মারিশবুনিয়া গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সেক্রেটারি নুরুল আমিন তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন যে পাহাড়ে ডাকাতেরা ছোট ছোট আলো ফেলে ঘোরাঘুরি করছে। লিয়াকত তখন মাদক উদ্ধার অভিযান থেকে ফিরছিলেন। নুরুল আমিন আবার ফোন করে বলেন, সেনাবাহিনীর পোশাক পরা সেই লোকেরা গ্রামবাসীকে গুলি করেছে। তারা সিলভার রঙের গাড়িতে করে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছে। নুরুল আমিনও কমিটির কাছে একই কথা বলেছেন। কমিটি বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ৩৫ জন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যাঁরা কেউই এ কথা জানতেন না। কথা হয়েছে শুধু লিয়াকত ও নুরুল আমিনের মধ্যে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, লিয়াকত সেই খবর কাউকে জানাননি, এমনকি ওসি বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকেও না। তিনি খবর যাচাই করার জন্য ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান বা স্থানীয় কাউকে ফোন করেননি। কোনো সহকর্মীকেও সেটা বলেননি। লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, খবর যাচাই করার সময় তিনি পাননি। মারিশবুনিয়ার মসজিদ থেকে যখন ‘ডাকাত’ বলে মাইকিং করা হচ্ছিল, তখন নিষেধ করেছিলেন ইমাম জহির আলম। তিনি বলেছিলেন, এরা সেনাবাহিনীর লোক, পাহাড়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এভাবে লিয়াকতকে বারবার ফোন করা শুধু ডাকাতের ভয়, না অন্য কোনো কারণে, তা জানতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।

সিদ্ধান্ত লিয়াকতের একার

পাহাড় থেকে নেমে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে আসার আগে মেজর (অব.) সিনহা বিজিবির একটি চৌকিতে থেমে ছিলেন। বিজিবির সদস্য সিনহার পরিচয় জানার পর তাঁকে স্যালুট করেছিলেন। সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার আসার পর শামলাপুর তল্লাশিচৌকি, যেখানে সিনহাকে গুলি করা হয়। এর এক–দেড় কিলোমিটার দূরে সেনাবাহিনীর তল্লাশিচৌকি। এপিবিএন সদস্যরা কমিটিকে বলেছেন, লিয়াকত চৌকিতে এসে কিছু বলেননি। তিনি শুধু তল্লাশিচৌকির এসআই শাজাহানকে ফোন করেছিলেন। তা ছাড়া তিনি
যখন ফোনে ডাকাতের খবর পেয়েছিলেন, তখনো তাঁর সঙ্গে পুলিশের এক​টি দল ছিল। কিন্তু তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। কমিটি বলেছে, লিয়াকতের এমন কর্মকাণ্ড অপেশাদারি, খামখেয়ালি, রহস্যজনক ও প্রশ্নসাপেক্ষ।

সিনহার কোন হাত কোথায় ছিল

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সিনহার গাড়ি তল্লাশিচৌ​কিতে এলে কনস্টেবল রাজীব সংকেত দেন। গাড়ি থেমে যায়। বাঁ দিকের কাচ নামিয়ে সিনহা পরিচয় দিলে এসআই শাজাহান পেছনে​ সরে যান। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। এরপর লিয়াকত এসে ব্যারিকেড দিয়ে পিস্তল তাক করেন এবং সিনহাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। সিনহার সঙ্গী সিফাত কমিটিকে বলেছেন, সিনহার নির্দেশে তিনি গাড়ি থেকে নেমে যান। গাড়ির দুই সিটের মাঝখানে রাখা পিস্তলে সিনহাকে হাত দিতে দেখেন সিফাত। কিন্তু নামার সময় কী হয়েছিল, তা তিনি আর দেখেননি।

সিনহার গাড়ি থেকে নামা নিয়ে পুলিশের একেক সদস্য কমিটির কাছে একেক রকম তথ্য দিয়েছেন। এসআই শাজাহান বলেছেন, সিনহাকে তিনি নামার সময় দেখেননি, দাঁড়ানোর সময় দেখেছেন। তিনি পিস্তল তাক করেননি। কনস্টেবল রাজীব বলেছেন, সিনহার এক হাত ওপরে এক হাত নিচে ছিল। কনস্টেবল আবদুল্লাহ বলেছেন, সিনহাকে অস্ত্র তাক করতে দেখেননি। তাঁর পিস্তল খাপের মধ্যে ছিল। সেটা বের করতে গেলেই লিয়াকত গুলি করেন। এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত কমিটিকে বলেন, লিয়াকত ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্র তাক করে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। এরপর ...শুট শুট বলেই গুলি করেন লিয়াকত।

তদন্ত কমিটি নন্দদুলালের কাছে জানতে চান, কীভাবে সিনহা গাড়ি থেকে নামেন। নন্দদুলাল বলেন, ‘সেটা খেয়াল করিনি।’ যদিও টেকনাফ থানায় করা মামলার এজাহারে নন্দদুলাল লিখেছেন, সিনহা গাড়ি থেকে নেমে অস্ত্র বের করতে উদ্যত হলে লিয়াকত তাঁকে গুলি করেন।

অপরদিকে গুলিবর্ষণকারী লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, ‘সিনহা গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত হয়ে আমার দিকে গুলি করেন।’ তবে কমিটির জেরায় লিয়াকত বলেছেন, গাড়ি থেকে নামার সময় সিনহা ডান হাত কোমরে রাখেন, এরপর পিস্তল তাক করে গুলি করেন। কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, সবাই বলেছে বাঁ হাত ওপরে ছিল। কিন্তু ডান হাত কোথায় ​ছিল, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। একেকজন একেক কথা বলেছেন।

লিয়াকত কি ঝুঁকিতে ছিলেন

তদন্ত কমিটির কাছে লিয়াকত বলেছেন, তিনি জানমালের নিরাপত্তার জন্য গুলি করেছিলেন। কিন্তু এসআই শাজাহান বলেন, ওই সময় লিয়াকতের স্থলে তিনি হলে গুলি করতেন না। গুলি করার কারণ হিসেবে তিনি লিয়াকতের অনভিজ্ঞতা ও সোর্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন। কনস্টেবল রাজীব বলেন, লিয়াকত গুলি না করলে সিনহা গুলি করতেন কি না, তা তিনি বুঝতে পারেননি। আবার নন্দদুলালের কাছে কমিটি জানতে চেয়েছিল, ওই সময় লিয়াকতের জীবনের কোনো শঙ্কা ছিল কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এ রকম চিন্তা করিনি।’

অন্য সব সাক্ষী কমিটির কাছে যেসব কথা বলেছে তাতে কমিটি মনে করে, সিনহাকে মেরে ফেলার জন্য গুলি করা হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক কমিটিকে বলেছেন, একটি গুলি দূর থেকে করা হলেও পরের সব গুলি খুব কাছ থেকে করা হয়েছিল।

কমিটি লিয়াকতের কাছে জানতে চেয়েছিল, আত্মরক্ষার জন্য কটি গুলির প্রয়োজন? জবাবে লিয়াকত বলেছেন, তখন সেটা গোনার সময় ছিল না।

কমিটি মনে করে, সঠিক তথ্য যাচাই করলে, অভিযানের আগে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিলে গুলিবর্ষণ এড়ানো যেত। দরকার হলে লিয়াকত বিজিবি ও সেনাবাহিনীরও সহযোগিতা নিতে পারতেন। এটা ‘অপেশাদারি, চরম সমন্বয়হীনতা ও ক্রেডিট হাইজ্যাকের কুফল’ বলে কমিটি মনে করে।

ওসি প্রদীপের মুখে অন্য কথা

সিনহাকে গুলিবর্ষণের ঘটনা নিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে ফোন করেছিলেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। সেই ফোনে তিনি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন, তিনি লিয়াকতকে গুলি করতে বলেছেন। প্রদীপের এই ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে প্রদীপ বলেছেন, তিনি লিয়াকতকে গুলি করতে বলেননি। আবার লিয়াকত যে সিনহার গায়ে গুলি করেছেন, সেটাও তাঁকে বলেননি বলে কমিটিকে জানান প্রদীপ। আর লিয়াকত কমিটিকে বলেছেন, তিনি কী বলেছেন তার রেকর্ড আছে।

সাজানো মামলা

যে ট্রাকে করে সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সেই ট্রাকের চালক সাইফুল আফসার কমিটিকে বলেছেন, প্রদীপ আসার পর কনস্টেবল মামুন সিনহার গাড়ির ভেতরে দুটি প্যাকেট রাখেন। গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে তিনি এ দৃশ্য দেখেন। আর প্রত্যক্ষদর্শী সারওয়ার কামাল বলেন, লামার বাজারের বাবুলের দোকান থেকে কনস্টেবল মামুন ২০০ টাকায় এ গাঁজা কিনেছিলেন।

ঘটনার পর সিনহা ও সিফাতের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়, তা সাজান ওসি প্রদীপ। মামলার বাদী নন্দদুলাল কমিটিকে বলেন, ওসি স্যার কারও সঙ্গে পরামর্শ করে এই মামলা করতে বলেন।

অন্যদিকে সিনহাকে গুলি করার ২০-২৫ মিনিট পর প্রদীপ আসেন ঘটনাস্থলে। এর আগে সিনহাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রদীপ আসার ২২ মিনিট পর সিনহাকে ট্রাকে তোলা হয়। কমিটি বলেছে, হাসপাতালে যেতে অস্বাভাবিক দেরি হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় সিনহা মারা যান। আবার নিহতকে দায়ী করে মামলাও করা হয়। এটা টেকনাফে হরহামেশা ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলেই কমিটি মনে করে।

বন্দুকযুদ্ধ প্রসঙ্গে কমিটি

তদন্ত কমিটি বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে টেকনাফে বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণের কারণে লিয়াকতের মনে এ ধরনের অসংবেদনশীল মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আত্মরক্ষার আইনের ব্যাপারে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও আত্মরক্ষার অজুহাতে তাঁরা গুলি করেন। এসব গুলিবর্ষণের ঘটনা যাচাই করে কমিটি দেখতে পায়, বেশির ভাগ ঘটনার নির্বাহী তদন্ত হয়নি। যেগুলোর হয়েছে তাতেও পুলিশ প্রবিধান মানা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে কমিটি সন্দেহ প্রকাশ করে।

কমিটি বলেছে, এভাবে ব্যক্তিবিশেষ আইনি বিধানের অপপ্রয়োগ করে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছেন। লিয়াকতের গুলিবর্ষণ সেই প্ররোচনারই ফল। সেখানকার জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে কমিটি বলেছে, পুলিশের ভাড়া খাটা মাইক্রোবাসের চালক দিদার আলী কমিটিকে বলেছেন, টেকনাফে পুলিশের কথা শুনলে মানুষ ভয়ে প্রস্রাব করে দেয়।

ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ করতেন প্রদীপ

তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেছেন, তাঁর দায়িত্বের সময়ে যেসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে বেশির ভাগ জায়গাতেই তিনি নিজের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কমিটির সদস্যরা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার সময়কালে ১০৬টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হয়েছে—এগুলো কি আপনি সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?’ প্রদীপ বলেছেন, বেশির ভাগই তাঁর নেতৃত্বে হয়েছে। কমিটি জানতে চেয়েছিল, ‘আপনি কতবার নিজে গুলি করেছেন, কী অস্ত্র দিয়ে?’ জবাবে প্রদীপ বলেছেন, তিনি ২০–৩০ বার গুলিবর্ষণ করেছেন, ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে।

প্রদীপ তদন্ত কমিটিকে জানান, তাঁর সাড়ে ৭ লাখ টাকা দামের একটি ওয়াল্টার পিস্তল আছে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যেটা আরামদায়ক মনে হয়, আমি সেটা ব্যবহার করি।’ কমিটির প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, জিডি করে নিজের পিস্তলের গুলির হিসাব রাখতেন।

পরিদর্শক লিয়াকত সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ওসি প্রদীপ বলেন, ‘লিয়াকত ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খায়। সে আমাকে না জানিয়ে এসপিকে ফোন দেয়।’

কক্সবাজারে টেকনাফ থানার দেয়ালে সাঁটা রয়েছে প্রদীপের বিশাল আকারের ছবি। তদন্ত কমিটির বিস্ময়ভরা প্রশ্ন, একজন সরকারি কর্মকর্তা কোন পর্যায়ে উন্নীত হলে তার প্রতিকৃতি দেয়ালে শোভা পায়! এ ছাড়া তিনি নিয়ম ও আচরণবিধি ভেঙে বিদেশি দূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন, প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করেছেন। এসব তাঁর সীমাহীন ঔদ্ধত্য বলে কমিটি মনে করে।

১৩ সুপারিশ

সিনহা হত্যার মতো ঘটনা প্রতিরোধে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এর প্রথম দফা হলো, আত্মরক্ষার অধিকার নিয়ে যে আইন আছে, তা প্রয়োগের ব্যাপারে কার্যকরী নির্দেশনা দেওয়া, যাতে এর অপব্যবহার না হয়। এ ছাড়া সরকারি অস্ত্র না নিয়ে খালি হাতে বা ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে দায়িত্ব পালনের পালনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা, গুলি করার ঘটনার নির্বাহী তদন্তের ক্ষেত্রে লিয়াকতসহ তাঁর নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পর্যালোচনা করা, সিনহা হত্যার ঘটনার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরও সচেতন হওয়া, তল্লাশিচৌকিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের বুকে ক্যামেরা লাগানো এবং ওসিদের একই জেলায় পদায়ন ও পছন্দের ফোর্স গঠনের ব্যাপারে তদন্ত করা উল্লেখযোগ্য।

কমিটির সুপারিশে ওসি প্রদীপসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করতে হবে। যেখানে বিভিন্ন ক্যাডারের অভিজ্ঞ লোকজন প্রেষণে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তবে এই সুপারিশের সঙ্গে কমিটিতে থাকা পুলিশের প্রতিনিধি জাকির হোসেন খান একমত পোষণ করেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের এই বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজি ও বর্তমানে সরকারি দলের সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে কী করে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাই বিস্ময়ের। এক বা একাধিক ব্যক্তি হয়তো ব্যক্তিস্বার্থে এসব করছে, তাহলে তাদের তদারককারীরা কী দায়িত্ব পালন করেছেন? তাঁরা কি দুর্বৃত্তদের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন? তাঁদের উচিত ছিল মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি মানুষের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত না করেন, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

কক্সবাজারে কী করে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাই বিস্ময়ের।
নূর মোহাম্মদ, পুলিশের সাবেক আইজি ও বর্তমানে সরকারি দলের সাংসদ