আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে সম্পৃক্ততার দায়ে গ্রেপ্তার টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়াকে আদালত খালাস দিয়েছেন। আদালত রায়ে বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষ কোনো নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ এ কথা মানতে নারাজ।
২০১৪ সালের ৯ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত টিপু কিবরিয়া একজন জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিপু কিবরিয়া গ্রেপ্তার হন। পুলিশ জানায়, তিনি আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্য। টিপু কিবরিয়া ও তাঁর তিন সহযোগী পথশিশুদের নগ্ন ছবি টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাচার করে থাকেন। এর বিনিময়ে বিদেশ থেকে টাকা পান তাঁরা। এ ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করে সিআইডি।
টিপু কিবরিয়ার লেখা কিশোর হরর সিরিজের বইগুলোর পেছনে দুটি লাইন লেখা থাকত, ‘পাঠক, সাবধান! ভয়ের জগতে প্রবেশ করছ তুমি!!’ ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি একজন সাদাসিধা মানুষ। সদা সত্য কথা বলার চেষ্টা করি। লেখালেখি করি, ছবি তুলি। ৫০টার মতো বই লিখেছি, যার অধিকাংশ ছোটদের জন্য। ধরণীর আলো দেখেছিলাম সেই ১৯৬৬ সালের ১১ নভেম্বর।’
আদালতে সাত পুলিশ সদস্য ও তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া নিরপেক্ষ আরও চার সাক্ষীকে হাজির করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। টিপু কিবরিয়া ও একই দিনে গ্রেপ্তার মো. নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ মামলায় পুলিশ এক পথশিশুকেও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে। কী করে এ চক্রের খপ্পরে পড়েছিল, সে সম্পর্কে শিশুটি বিবরণ দেয়।
ছয় বছর পর গত বছরের নভেম্বরে মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি আসামি টি আই এম ফকরুজ্জামাম ওরফে টিপু কিবরিয়া, মো নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া, মো নুরুল ইসলাম ও মো. শাহারুল ইসলামকে খালাস দেন। কেন আসামিদের খালাস দিয়েছেন, সে সম্পর্কেও তিনি রায়ে উল্লেখ করেছেন।
আদালত যেসব জায়গায় পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সে জায়গাগুলো আমরা দেখেছি। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি।নজরুল ইসলাম, সিআইডির বিশেষ সুপার (লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স)
মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্তে তাঁরা কোনো খামতি রাখেননি। পর্নোগ্রাফি তৈরিতে যেসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার হয়েছিল, সেগুলোর ফরেনসিক করা হয়। সেসব তথ্য আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। তাঁরা হাইকোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সিআইডির বিশেষ সুপার (লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স) নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত যেসব জায়গায় পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সে জায়গাগুলো আমরা দেখেছি। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের জন্য আমরা প্রস্তুত হচ্ছি।’
আদালত তিনটি বিষয় বিবেচনা করেছেন। এগুলো হলো আসামিরা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে আপলোড করেন এবং হার্ড ডিস্কে সংরক্ষণ করেন বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে। এই হার্ডডিস্কগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়েছিল কি না, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮–এর ৩,৬ ও ৭ নম্বর ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে কি না এবং আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিরা আর কী সাজা পেতে পারে।
শিশুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছিল, একদিন সে স্টেশনে বসে তাল খাচ্ছিল। এমন সময় একটা ‘বুড়া লোক’ এসে তার সঙ্গে ভাব জমায়। জানতে চায়, সে ভাত খেতে চায় কি না। ভাত খাওয়ার জন্য পকেট থেকে ৩০ টাকা বের করে দিয়ে একটা চাকরিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শিশুটি নুরুলের হাত ধরে তাঁর বাসায় যায়। কিন্তু বাসায় নিয়ে গেলে সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, মুঠোফোন বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য করা হবে। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান আছে। এ আইনের ৪ ধারায় শিশু পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, বিক্রি বা প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার কথা বলা আছে। আর ৭ ধারায় বলা হয়েছে, এ অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বা সহায়তাকারী ব্যক্তি প্রত্যেকেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফতাব উদ্দীন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালান। ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে গোড়ান রেলগেট এলাকায় তিনি টিপু কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার করেন। তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরি করার কথা স্বীকার করেন এবং জানান, তাঁর বাসায় পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম আছে।
ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ টিপু কিবরিয়ার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে হার্ড ডিস্ক ও কিছু যন্ত্রাংশ উদ্ধার করে। এই যন্ত্রাংশগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়। পুলিশ সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন। পরে টিপু কিবরিয়া বলেন, মুগদার মানিকনগরের একটি ভাড়া বাসায় পর্নোগ্রাফি তৈরি করেন। সেখানে গিয়ে পুলিশ আসামি নুরুকে একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় পায়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া আলামত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে চারজন নিরপেক্ষ সাক্ষী হাজির করেন। আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, এই সাক্ষীদের সবাই বলেছেন, তাঁদের কাছ থেকে পুলিশ সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। তাঁরা কোনো জবানবন্দি দেননি। আসামিদের কাছ থেকে কী কী জিনিস উদ্ধার হয়েছে, সে ব্যাপারে তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি।
আদালত রায়ে আরও বলেছেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি মামলাটি তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। কিন্তু আসামিপক্ষের জেরায় তিনি বলেছেন, কোনো শিশু বা ভুক্তভোগী কারও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। আসামিরা ইন্টারনেটে ছবি আপলোড করে বিদেশি ডলার আয় করতেন বলে তথ্য আছে অভিযোগপত্রে। কিন্তু কোনো ব্যাংক হিসাব পাননি। এমনকি তদন্তের সময় এ মামলায় ভুক্তভোগী হিসেবে যে কিশোর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বক্তব্য দিয়েছে, তাকেও আদালতে হাজির করা হয়নি।
আদালত আরও বলেছেন, কোন কোন দেশে পাচার করা হয়েছিল, তা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি। তা ছাড়া পুলিশ বলেছে, তারা আসামি ও ভুক্তভোগী শিশুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। জেরায় দাবি করেছে, ওই সময় মানিকনগরের বাসার দরজাও খোলা ছিল। আদালত মনে করে, পর্নোগ্রাফি উৎপাদনের সময় ঘরের দরজা খোলা রাখার যে কথা পুলিশ বলেছে, তা সত্য নয়।
আদালত তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশে বলেছেন, জবানবন্দিতে আসামিরা কখন, কোথায়, কয়টায় পর্নোগ্রাফি উৎপাদন ও তা পাঠানোর কাজ করেছেন, তা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। আসামিরা যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেই জবানবন্দির পক্ষে নিরপেক্ষ সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেননি।
এ মামলায় পুলিশ ভুক্তভোগী একটি শিশুকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে। যদিও বিচারের সময় তাকে আর আদালতে তোলেনি পুলিশ। শিশুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছিল, একদিন সে স্টেশনে বসে তাল খাচ্ছিল। এমন সময় একটা ‘বুড়া লোক’ এসে তার সঙ্গে ভাব জমায়। জানতে চায়, সে ভাত খেতে চায় কি না। ভাত খাওয়ার জন্য পকেট থেকে ৩০ টাকা বের করে দিয়ে একটা চাকরিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শিশুটি নুরুলের হাত ধরে তাঁর বাসায় যায়। কিন্তু বাসায় নিয়ে গেলে সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
টিপু কিবরিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে সেবা প্রকাশনীর কিশোর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে ১০ বছর চাকরি করেছেন। তাঁর একটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ছিল। সেবা প্রকাশনীতে চাকরির সময় তাঁর ৫০টি কিশোর উপন্যাস বের হয়। ২০০৩ সাল থেকে তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন। নুরুলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০০০ সালে মুগদা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে। আলাপ-আলোচনায় তিনি বুঝতে পারেন, নুরুল ইসলাম অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে থাকেন।
পরে এই নুরুলের সঙ্গে তিনি জোট বাঁধেন। ঢাকা শহরের কল্যাণপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ নানা জায়গা থেকে বাচ্চাদের ছবি তোলার কাজের কথা বলে নিয়ে আসতেন নুরুল। নুরুলকে নিয়ে টিপু কিবরিয়া শিশুদের ছবি তুলতেন এবং ভিডিও ফুটেজ তৈরি করতেন। তিনি নিয়মিত ইন্টারনেটে ওই সব ছবি ও ভিডিও আপলোডও করতেন। একটা সময় কয়েকজন বিদেশি তাঁকে শিশুদের নগ্ন ছবি পাঠাতে বলেন। বিনিময়ে তাঁরা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা পাঠাতেন। ওই সব টাকা/কারেন্সি তিনি মৌচাক, উত্তরা, মতিঝিলের ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে তুলেছেন।
টিপু কিবরিয়া জবানবন্দিতে এ–ও বলেছিলেন, তাঁর মক্কেলরা জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। যাঁদের কাছে তিনি এসব ছবি ও ভিডিও পাঠাতেন, তাঁদের ই–মেইল ঠিকানাও তাঁর কম্পিউটারে আছে। প্রতি মাসে এ কাজ করে টিপু কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা পেতেন টিপু। ওই টাকা দিয়ে তিনি নিজে চলতেন, আর প্রতি সপ্তাহে নুরুল ইসলাম ও নুরুল আমিনদের দুই হাজার টাকা করে দিতেন। যে ছেলেদের যৌন নির্যাতন করা হতো, তাদের দিতেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
মামলার তদন্তকালীন সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে জানা গেছে, টিপু কিবরিয়া তাঁর তৈরি পর্নোগ্রাফি ১৩টি দেশের ১৩ নাগরিকের কাছে পাঠাতেন। এসব বিদেশি নাগরিককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে আছে কানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।