২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঘটেছে এমন জালিয়াতির ঘটনা।
এসব চিকিৎসককে কারণ দর্শানো হয়েছে ২০২০ সালে এসে।
এই বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
অভিনব উপায়ে জালিয়াতির অভিযোগ তাঁদের নামে। সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পেতে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য হাজির করেছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগে। তবে শেষরক্ষা হয়নি। পদোন্নতি দেওয়ার আগেই সব ফাঁস হয়ে গেছে। অসদাচরণের দায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে শতাধিক কর্মকর্তাকে।
২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঘটেছে এমন জালিয়াতির ঘটনা। তবে এসব চিকিৎসককে কারণ দর্শানো হয়েছে ২০২০ সালে এসে। এ বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
নিয়ম অনুযায়ী, পদোন্নতির পরীক্ষা গ্রহণ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। জালিয়াতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এর চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এসব অনিয়মের কথা তাঁদের জানার কথা নয়। তবে কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ আসে, তবে তাঁরা খতিয়ে দেখবেন।
পিএসসি সূত্র জানায়, সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতির জন্য তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম পত্র বাংলাদেশ ও চলতি বিষয়াবলি, দ্বিতীয় পত্র সব সরকারি অফিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন, বিধি ও পদ্ধতি, তৃতীয় পত্র সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের (স্বাস্থ্য) কাজকর্ম–সম্পর্কিত বিষয়াদি। একজন কর্মকর্তা একসঙ্গে তিনটি অথবা কমসংখ্যক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য চাকরির বয়স কমপক্ষে চার বছর ও চাকরি স্থায়ী হতে হবে। সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতির জন্য সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অনুত্তীর্ণ হলে পদোন্নতি হবে না।
অসদাচরণের দায়ে শতাধিক কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
পিএসসির সাবেক একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেকেই একসঙ্গে তিনটি পরীক্ষায় পাস করতে পারেন না। এর ফলে তাঁরা পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়েন। তখন এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেন। বিশেষ করে যেসব চিকিৎসক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের মধ্যে যেকোনো প্রকারে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য তোড়জোড় বেশি দেখা যায়।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের অন্যায়ের ধরন দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। এমনও জালিয়াতি হতে পারে? তবে অন্যায় করলে কেউ ছাড় পাবে না।’
অভিযুক্ত কয়েকজন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখা যাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার সাজ্জাদ হোসেন। তিনি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে পদোন্নতির জন্য ২০১৮ সালে পিএসসির পরীক্ষায় অংশ নেন। নোটিশে বলা হয়েছে, সাজ্জাদ হোসেন পদোন্নতি পরীক্ষায় শুধু তৃতীয় পত্রে উত্তীর্ণ হয়েও জালিয়াতির মাধ্যমে এ–বিষয়ক গেজেট পরিবর্তন করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রে পাস করেছেন বলে তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
একই অভিযোগ রয়েছে মাগুরা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধেও। তিনি ২০১০ সালের পরীক্ষায় প্রথম ও তৃতীয় পত্রে উত্তীর্ণ হলেও জালিয়াতির মাধ্যমে গেজেট পরিবর্তন করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রে পাস করেছেন বলে উল্লেখ করেন। আর এই মিথ্যা তথ্য দিয়ে পদোন্নতির জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে আবেদন করেছেন। তবে জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, কাগজপত্র জমা দেওয়ার সময় কোনো ঝামেলা বা ভুল হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তিনি কোনো মিথ্যা তথ্য দেননি।
স্বাস্থ্য বিভাগ তদন্ত করে দেখেছে, পদোন্নতির জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে অর্ধশতাধিক চিকিৎসক স্বাস্থ্য বিভাগে আবেদন করেছেন। এটা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ১৯৭৯–এর পরিপন্থী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮–এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণ।
শৃঙ্খলা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) মুমিনুল হক ২০১১ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৫০৫ জন কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ীকরণের আদেশ জালিয়াতি করে নিজের নাম ওই আদেশে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মুমিনুল হক নিজের দোষ স্বীকার করে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোকে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন পদোন্নতি হয় না বলে আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে কাগজপত্র রেখে যেতে বলেছিল। কিন্তু তারা যে এইভাবে আমার নাম ঢুকিয়ে দেবে, আমি বুঝতে পারিনি। তবে আমি পুরো বিষয়টির জন্য ক্ষমা চেয়ে শোকজের জবাব দিয়েছি।’
একইভাবে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হুমায়ূন কবির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিসিএস ক্যাডারের ২৫৫ জন কর্মকর্তার স্থায়ীকরণের আদেশ জালিয়াতি করে নিজের নাম ওই আদেশে যুক্ত করে দিয়েছেন।
দীর্ঘদিন পদোন্নতি হয় না বলে আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে কাগজপত্র রেখে যেতে বলেছিল। কিন্তু তারা যে এইভাবে আমার নাম ঢুকিয়ে দেবে, আমি বুঝতে পারিনি। তবে আমি পুরো বিষয়টির জন্য ক্ষমা চেয়ে শোকজের জবাব দিয়েছি।মুমিনুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেলের সিনিয়র কনসালট্যান্ট শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ প্রকাশনা নিয়ে। তিনি তাঁর পদোন্নতির জন্য একটি প্রকাশনা জমা দিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এই চিকিৎসক জালিয়াতির মাধ্যমে ছয়জন লেখকের পরে সাত নম্বরে নিজের নাম বসিয়ে ওই নিবন্ধের একটি ভুয়া কপি তৈরি করেছেন। মন্ত্রণালয় মূল বই ও সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে পাওয়া জার্নালের কপি যাচাই করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এ বিষয়ে শহিদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।