প্রতারণা

পথশিশুর নামে টাকা তুলে ভাগাভাগি

  • বেইলি রোডে এক নারী পরিচয় যাচাই করতে গিয়ে হামলার শিকার হন।

  • ৫০টি বাক্স নিয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো তরুণদের।

ফাইল ছবি

ঢাকার রাস্তায় যানজটে গাড়িতে বসে আছেন। বাক্স হাতে আপনার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছেন কিছু তরুণ-তরুণী। তাঁদের গায়ে এক রঙের টি-শার্ট। বিশ্বাস করে তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে টাকা দেন অনেকে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পথশিশুদের শিক্ষা ও খাবার সরবরাহের কথা বলে এভাবে টাকা তুলে আসছিলেন শতাধিক তরুণ-তরুণী। ‘প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনে’র নামে টাকা তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হতো। শুধু তা-ই নয়, পথশিশুদের নামে তোলা টাকায় ভুঁইফোড় এই সংগঠনের সবুজবাগ অফিসে মাদকের আড্ডা বসত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

কোনো ধরনের বৈধ নথিপত্র ছাড়াই সমাজসেবার নামে সাত বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল সংগঠনটি। চাকরির কথা বলে তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ দিত। তারপর ওই তরুণ-তরুণীদের দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতেন তাঁরা। কেবল রাজধানীতেই ৫০টি বাক্স নিয়ে এই সংগঠনের ব্যানারে পথশিশুদের নামে টাকা তোলা হতো। প্রতিটি বাক্সে দিনে দু-তিন হাজার টাকা করে সংগ্রহ হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কর্মকর্তারা। সে হিসাবে মাসে এই টাকার অঙ্ক গিয়ে দাঁড়াত ৩০ লাখের বেশি।

ফাইল ছবি

রাজধানীর বেইলি রোডে সম্প্রতি পথশিশুদের শিক্ষা ও খাবার দেওয়ার কথা বলে টাকা তোলার সময় দুই তরুণ-তরুণীকে সন্দেহ হয় এক পথচারী নারীর। ডিবি জানিয়েছে, পরিচয় জানতে চাইলে ওই নারীর কাছে তাঁরা নিজেদের প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক বলে দাবি করেন। টাকা সংগ্রহকারীরা আরও দাবি করেন, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁরা পথশিশুদের জন্য কাজ করছেন। যদিও ওই নারী তাঁদের পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে তাঁরা দেখাতে পারেননি। পরে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ওই নারীর ওপর হামলা করেন তাঁরা।

হামলার শিকার নারী ডিবির কাছে অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে গত শুক্রবার রাজধানীর রমনা থেকে সংগঠনের চেয়ারম্যান ইমন চৌধুরীসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১ হাজার ২০০ ইয়াবা বড়ি ও ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।

প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইমন চৌধুরীসহ দুজন গ্রেপ্তার। চাকরির কথা বলে টাকা তোলানো হতো তরুণদের দিয়ে।

ডিবির উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশী প্রথম আলোকে বলেন, পথশিশুদের নামে টাকা তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিতেন এই চক্রের সদস্যরা। এই টাকায় অফিসে বসত মাদকের আসর। মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণীদের টাকা তোলার কাজের বিনিময়ে মাদক সরবরাহ করা হতো। গ্রেপ্তার দুজনের বিরুদ্ধে গত শনিবার রমনা থানায় মামলা হয়েছে।

ডিবি সূত্রে জানা যায়, প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশন প্রচার করত যে তারা পথশিশুদের শিক্ষার জন্য ১৭টি স্কুল পরিচালনা করে। প্রতিদিন কয়েক শ পথশিশুকে খাবার দেয়। কিন্তু আসলে এই সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে কোনো কাজই করে না। ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন টাকা সংগ্রহ শেষে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। অর্ধেক পান সংগঠনের চেয়ারম্যান। বাকি টাকা পান টাকা তোলার দায়িত্বে থাকা তরুণ-তরুণীরা। প্রতারণার টাকায় সংগঠনের চেয়ারম্যান ইমন চৌধুরী রাজধানীতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া সবুজবাগ ও খিলগাঁও এলাকায় দুটি জাঁকজমকপূর্ণ অফিস রয়েছে তাঁর।

চাকরি খুঁজতে গিয়ে এই প্রতারণার সঙ্গে অনেক তরুণ-তরুণী জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানায় ডিবি। কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। আবার অনেকে জেনেশুনে চালিয়ে যান প্রতারণা। এ ছাড়া এই চক্রের সদস্যরা শীতের পোশাক সংগ্রহ করতেন। সেই শীতবস্ত্রও পথশিশুদের দেওয়া হতো না। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হতো।

বিজ্ঞাপন দেখে একটি শোরুমের বিক্রয়কর্মীর চাকরি ছেড়ে প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনে যোগ দিয়েছিলেন লাইজু আক্তার নামের এক তরুণী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে ৫ বছর আগে তিনি এই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। তবে অফিসে কাজের কথা বলে তাঁকে দিয়ে টাকা তুলতে বাধ্য করা হতো। কোনো বেতন দেওয়া হতো না। পথশিশুদের নামে যে টাকা তোলা হতো, তার একটা ভাগ পেতেন তিনি। নিরুপায় হয়ে তিনি তিন বছর এ কাজ করেন।

এই তরুণী আরও বলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিতে চাইলে সংগঠনের চেয়ারম্যান ইমন আমাকে নির্যাতন করেন। একপর্যায়ে আমি পালিয়ে যাই।’

প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনে দেড় মাস আগে যোগ দেওয়া রুবি আক্তার প্রথম আলোর বলেন, ‘অফিসে কাজের কথা বলে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে রাস্তায় টাকা তুলতে পাঠানো হয়।’

ডিবি জানিয়েছে, প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনের প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসায় এ ধরনের অন্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রতারণার তথ্য পেলে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার আছমা আরা জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিনই এভাবে বাক্স হাতে টাকা তুলতে দেখা যায়। কিন্তু সাহায্যের নামে তোলা এই টাকা যে আত্মসাৎ করা হয়, তা আমাদের জানা ছিল না। এখন অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।’