নেপালিদের সহায়তার দায়ে তিনজনকে শাস্তি

অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মী চাকরিচ্যুত। পুলিশের এক এএসআইয়ের পদাবনতি ও আরেক সদস্যের প্রণোদনা কেটে নেওয়া হয়েছে।

ফাইল ছবি

ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো–কাণ্ডে যুক্ত ১৩ নেপালিকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ ছিল দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে। বিভাগীয় তদন্তে সে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। পরে তিনজনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে তাঁদের কর্তৃপক্ষ।

বিভাগীয় পদক্ষেপ নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্ররক্ষা বিভাগের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) গোলাম হোসেন ওরফে মিঠুকে পদাবনতি করে নায়েক ও রমনা থানার কনস্টেবল দীপঙ্কর চাকমাকে ১০ বছরে একটি করে বার্ষিক প্রণোদনা কেটে নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত অন্যজন একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহকারী প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আক্তার হোসেন। তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।  

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ওয়ালিদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের পরিভাষায় এ ধরনের শাস্তিকে গুরুদণ্ড বলা হয়। শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যরা ইতিমধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন।

ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও বনানীর ঢাকা গোল্ডেন ক্লাবের অবৈধ ক্যাসিনোতে অভিযান চালান। অভিযানের পরপরই র‌্যাব জানতে পারে, এসব অবৈধ ক্যাসিনোর কারিগরি কাজ করতেন একদল নেপালি। কিন্তু অভিযানের সময় তাঁদের ধরা সম্ভব হয়নি। তদন্তে নেমে র‌্যাব জানতে পারে, অভিযানের সময় সুকৌশলে তাঁদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়। নেপালিদের পালাতে সহায়তা করার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ডিএমপির প্ররক্ষা বিভাগের এএসআই গোলাম হোসেন ও রমনা থানার কনস্টেবল দীপঙ্কর চাকমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করে ডিএমপি।

# ক্যাসিনো–কাণ্ড ও বিশেষ অভিযানে ধরা পড়া ১৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৫৮টি মামলা হয়েছে। ২৩ মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে। ৩৫ মামলার তদন্ত চলছে।# ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও বনানীর ঢাকা গোল্ডেন ক্লাবে অভিযান চালানো হয়।

অপরদিকে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত শেষে সম্প্রতি তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালানোর পরপরই র‌্যাব জানতে পারে, এসব অবৈধ ক্যাসিনোতে কাজ করা একদল বিদেশি নাগরিক আত্মগোপন করেছেন। ওই দিন রাতে তাঁদের ধরতে নয়াপল্টনে ও সেগুনবাগিচায় সামিট হাসান লজ নামের একটি ভবনে অভিযান চালায় র‌্যাব। কিন্তু অভিযানের আগেই ১৩ নেপালি পালিয়ে যান। পরে সেগুনবাগিচার ওই ভবনে অভিযান চালিয়ে ছয়জন নেপালির পাসপোর্ট উদ্ধার করে র‌্যাব। তাঁরা হলেন প্রসয়ন প্রবীণ, সিধাই নিরোজ, ড্যাঙ্গল বিকাশ নান, নাকর্মি গৌতম, রণজিৎ বচ্চন ও নয়াজি শেরেস্থা।

পরে সামিট হাসান লজের সিসি ক্যামেরায় একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, নেপালিরা ওই বাড়ি ছাড়ার আগে সেখানে কয়েকজন প্রবেশ করেন। তাঁদের একজনের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মতো ওয়াকিটকি ছিল। ওয়াকিটকি হাতে ওই ব্যক্তি সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ সদস্য বলে গণমাধ্যমে খবর আসার পর তা নাকচ করে দিয়েছিলেন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম। পরে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম দুই পুলিশ সদস্য গোলাম হোসেন ও দীপঙ্কর চাকমাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অপর লোকটি গোয়েন্দা সংস্থার সহকারী প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আক্তার বলে শনাক্ত করা হয়।

অভিযানের সঙ্গে যুক্ত র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যে বাড়িতে নেপালিরা থাকতেন, সেই বাড়ির সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছেন। তদন্ত করে তাঁরা জানতে পারেন, ক্লাবের পাশাপাশি ফ্ল্যাটে চলা ক্যাসিনোতেও শতাধিক নেপালি যুক্ত ছিলেন। তাঁরা ভ্রমণ ভিসায় এসেছিলেন।

পুলিশের পরিভাষায় এ ধরনের শাস্তিকে গুরুদণ্ড বলা হয়। শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্যরা ইতিমধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন।
ওয়ালিদ হোসেন, উপকমিশনার, ডিএমপি

ক্যাসিনোতে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিলেন র‌্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। গতকাল শনিবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পালিয়ে যাওয়া নেপালিদের ব্যাপারে তাঁরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে সিসিটিভির ফুটেজসহ তাঁদের কাছে ছয়জনের ছবিযুক্ত পাসপোর্ট আছে। অভিযানের পর তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে নেপালে পালিয়ে গেছেন বলেও তাঁরা জানতে পারেন।

২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ক্যাসিনো–কাণ্ড ও বিশেষ অভিযানে ধরা পড়া ১৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানি লন্ডারিং ও দুদক আইনে ৫৮টি মামলা করেন র‌্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। এর মধ্যে র‌্যাব, পুলিশ ও সিআইডি ২৩ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। বাকি ৩৫ মামলার তদন্ত এখনো চলছে। ক্যাসিনোবিরোধী এ অভিযান ব্যাপক আলোচিত হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ যুবলীগের কতিপয় নেতা–কর্মী সরাসরি ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারবার থেকে আয় করা কোটি কোটি টাকা তাঁরা বিদেশেও পাচার করেছিলেন।