>• জঙ্গিবিরোধী ২১ অভিযান
• জঙ্গিবাদে সন্তান নিহত হলেও একঘরে হওয়ার ভয়ে পরিবারগুলো পরিচয় শনাক্ত করতে আসে না
• ২০১৬ সালের জুলাই থেকে দুই বছরে ২১ অভিযানে ৮৫ জঙ্গি নিহত
• নিহত জঙ্গিদের শুধু সাংগঠনিক নাম জানা গেছে
• পরিচয় না পাওয়া মৃতদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন
গুলশানের হোলি আর্টিজানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গি হামলার পর থেকে গত বছরের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত পুলিশ ও র্যাবের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে ৮৫ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংগঠনিক নাম জানা গেলেও তাদের ২৪ জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহত ব্যক্তিদের সবাই আইএস মতাদর্শে বিশ্বাসী নব্য জেএমবির সদস্য বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
যৌথ বাহিনীর ২টি, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটি) ১৪টি এবং র্যাবের ৫টি অভিযানে সন্দেহভাজন ওই জঙ্গিরা নিহত হয়। এর মধ্যে র্যাবের অভিযানে নিহত ১৫ জনের পরিচয় এখনো অজানা। অজ্ঞাতনামাদের অন্য ৯ জন নিহত হয়েছে ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর গাজীপুরের নোয়াগাঁওয়ের পাতারটেকে সিটির অভিযানে এবং ২০১৭ সালের ২৪–২৭ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত যৌথ বাহিনীর অভিযানে।
‘অজ্ঞাতনামা’ থাকার পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমত, অনেকে পরিবারগুলো একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে সন্তানদের শনাক্ত করতে আসতে চান না। কেউ কেউ গোপনে এসে নমুনা দিয়ে চলে যান। দ্বিতীয়ত, যেসব অভিযানে বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে মৃতদেহগুলো পুড়ে যাওয়ায় নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি। ফলে অজ্ঞাতনামা হিসেবে লাশগুলো দাফন করা হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মিরপুরের বর্ধনবাড়িতে র্যাবের অভিযানে আবদুল্লাহর পরিচয় পাওয়া গেলেও সহযোগীদের পরিচয় জানা যায়নি। গত বছরের অক্টোবরে মিরসরাইয়ের অভিযানেও একই কারণে মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গি হামলায় কেউ নিহত হলে লাশ শনাক্ত করতে প্রথমেই জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আঙুলের ছাপ মেলে কি না, মিলিয়ে দেখা হয়। ডিএমপির সংবাদ–বিষয়ক পোর্টাল ডিএমপি নিউজে ছবি প্রকাশ করে পরিচয় জানতে চাওয়া হয় এবং নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
যাদের পরিচয় মেলেনি
২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর পুলিশ ও র্যাবের পৃথক অভিযানে এক দিনে মারা যায় ১১ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও ১ জন। গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার আশুলিয়ায় পরিচালিত ওই অভিযানে ৮ জনের পরিচয় এখনো অজানা। গাজীপুরের নোয়াগাঁওয়ে ওই দিন অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম। ‘অপারেশন স্পেট এইট’ নামের ওই অভিযানে নিহত হয় ৭ জন। কাছেই গাজীপুরের হাঁড়িনালে র্যাবের অভিযান ‘শরতের তুফান’–এ নিহত হয় আরও ২ জন।
এখন পর্যন্ত পাতারটেকে নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের ১ জনের নাম ফরিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ বলে জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা জানান, ফরিদুল নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগের অপারেশন কমান্ডার ছিল। পরে সব মৃতদেহ অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করে কর্তৃপক্ষ।
অপারেশন স্পেট এইটের পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট আশকোনার সূর্যভিলায় অপারেশেন রিপল ২৪ পরিচালনা করে। ২০১৭ সালের ১৫ ও ১৬ মার্চ পুলিশ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অ্যাসল্ট সিক্সটিনে একসঙ্গে দুটি আস্তানায় অভিযান চালায়। ওই অভিযানে নিহত ৫ জনের ৪ জন হলো বান্দরবনের কামাল ও জোবায়দা দম্পতি, তাদের সন্তানও মিরপুরের রাফিদ আল হাসান। পরিচয় পাওয়া যায়নি ১ জনের।
অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিনের সূত্র ধরে ৮ দিন পর ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী অভিযান চালায় সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে। ওই অভিযানে নিহত ৪ জনের ১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি বান্দরবানের বাইশারীর মনজিয়ারা। আতিয়া মহলের অভিযানকে কেন্দ্র সিলেটে হত্যা ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি মামলা করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দেওয়ান আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছিল মৃতদেহগুলোর একটি নব্য জেএমবি মুসার। মুসার মায়ের ডিএনএ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মেলেনি। তবে ওই সময় থেকে নিখোঁজ একজন তরুণের মৃতদেহ এখানে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একটি সূত্র বলছে, ওই অভিযানে নিহত আরও ২ জনের পরিচয় তাঁরা পেয়েছেন। ১ জনের নাম ফাহিম, অন্যজনের নাম খাববাব আল মিশরী। ফাহিমের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়নি। খাববাবের বাড়ি টাঙ্গাইল, শুধু এটুকুই জানা গেছে।
কাছাকাছি সময়ে ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ র্যাব সদর দপ্তরের ফোর্সেস ব্যারাকের সামনে এক তরুণ আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। পরদিন আমিরন নামের এক নারী তাঁকে নিজের সন্তান বলে দাবি করেন। তিনি জানান, ছেলেটির নাম রফিক। তবে যাচাই–বাছাই শেষে দেখা যায়, আত্মঘাতী তরুণটি তাঁর সন্তান নন।
একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর র্যাব মিরপুরের বর্ধনবাড়িতে ৫৬ ঘণ্টার অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানে নিহত হয় ৬ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আবদুল্লাহর পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকিদের শনাক্ত করা যায়নি।