ছবির মতো ছোট্ট শহর নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ। সবুজে ঘেরা শহর। চারদিকে সাজানো–গোছানো বাড়ি আর ঝকঝকে সড়ক। শহরের অধিবাসী বেশি নয়। অপরাধের ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। অথচ শান্তিপূর্ণ এই শহরের মসজিদে আজ বন্দুকধারীরা হামলা করেছে। বর্বরোচিত এই হামলায় মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। মৃতের সংখ্যা হয়তো আরও কম হতো। কিন্তু আহতদের ওপর বন্দুকধারীর দ্বিতীয় দফা গুলিতে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আহতদের অনেকে পানি চেয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়েও বাঁচতে পারেননি। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান এক আহত বাংলাদেশি। নাম তাঁর রুবেল। আল নুর মসজিদের ভেতরে আজ শুক্রবার বন্দুকধারীর গুলিতে আহত হয়ে তিনি ছটফট করছিলেন। এমন সময় মো. দিদার নামে আরেক বাংলাদেশি তাঁর ভাইয়ের খোঁজে মসজিদের ভেতরে এসেছিলেন। তাঁর কাছেই পানি চেয়েছিলেন গুলিবিদ্ধ রুবেল। দিদার তাঁকে পানি পান করান। আহত রুবেলকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে। সেখানে আজ বাংলাদেশ সময় বিকেলে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়।
দিদারের কাছ থেকে এই লোমহর্ষক ঘটনা শোনেন তাঁর বন্ধু এহসানুল বাশার। তিনি নিউজিল্যান্ডের এক প্রবাসী বাংলাদেশি। এহসানুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরও অনেকের মতো আমার বন্ধু দিদারকেও হয়তো আজ হারাতে হতো। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আল নুর মসজিদে ঢোকার সময়ই গুলির শব্দ শুনতে পান দিদার। গুলির শব্দ কানে আসতেই মসজিদের মূল ভবনের পাশের দরজা দিয়ে বাইরে চলে আসেন দিদার। বাইরে এসে সোজা চলে যান মসজিদের গাড়ি রাখার জায়গায়। বিরামহীন গুলির শব্দে একটি ব্যক্তিগত গাড়ির নিচে লুকিয়ে পড়েন দিদার। কিছু সময় পর গুলির শব্দ থেমে গেলে দিদার মসজিদের ভেতরে যান ভাই মিনারকে খুঁজতে। মিনারও পালিয়ে বের হয়েছিলেন। পরে দিদার মসজিদের ভেতরে ঢোকার পর দেখেন নারকীয় দৃশ্য।’
দিদারের বরাতে এহসানুল বাশার বলেন, আল নূর মসজিদের ভেতরে রক্তাক্ত অসংখ্য নিস্তেজ দেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল। গুলিবিদ্ধ অনেকে ছটফট করছিলেন। কেউ আবার এক ফোঁটা পানির জন্য কাকুতি–মিনতি করছিলেন। দিদারকে দেখে রুবেল নামের গুলিবিদ্ধ এক বাংলাদেশি পানি চেয়েছিলেন। তাঁকে পানি দিয়ে দিদার বাইরে চলে যান। ঠিক এই সময় বন্দুকধারী আবারও বন্দুকে গুলি ভরে মসজিদের ভেতরে আসে। আহত যাঁরা ছিলেন, বেছে বেছে তাঁদের দিকে আবারও গুলি চালায় বন্দুকধারী। এই দফায় রুবেল মৃত হওয়ার ভান করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন।
এহসানুল বাশার বলেন, ‘১৪ বছরের বেশি সময় ধরে নিউজিল্যান্ডে বসবাস করছি। কিন্তু অকারণে কাউকে একটুও চিৎকার করতে দেখেনি। আর উগ্রবাদী চিন্তা তো দূরের কথা। শ্রেণিভেদেও কারও মধ্যে নাক সিঁটকানো ভাব নেই। বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর ক্রাইস্টচার্চ। সেই শহরেই এই নৃশংস হামলা! এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।’
আতঙ্কের শহর ক্রাইস্টচার্চ
আজ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন ড. মেজবাহউদ্দিন চৌধুরী। হুট করেই শুনতে পান, বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লকডাউন’ হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীদের তাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনে ঢুকে পড়েন তিনি। লকডাউনের আগেই অবশ্য মানুষের মুখে মুখে তিনি জেনে যান সেই ভয়ংকর খবর। হামলা হয়েছে ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে। শুরু হয় চরম উৎকণ্ঠার সময়।
প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় মেজবাহউদ্দিন চৌধুরীর। স্থানীয় সময় অনুযায়ী ক্রাইস্টচার্চে তখন নেমে এসেছে রাত। রাস্তা তখন একদম ফাঁকা, গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু শোনা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার।
মেজবাহউদ্দিন চৌধুরী নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবুরির একজন শিক্ষক। ২০১৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি। হ্যাগলি পার্ক থেকে গাড়িতে এর দূরত্ব ১০ মিনিটের মতো। ঘটনার সময় শুক্রবার দুপুরে ক্যাম্পাসেই ছিলেন তিনি। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ছিল দুপুরে খাওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়। হঠাৎই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ক্রাইস্টচার্চ শহরই তখন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ওই মুহূর্তে পুরো শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত পদচারণ।
মেজবাহউদ্দিন বলেন, প্রথমে শুনেছিলেন একটি মসজিদে হামলা হয়েছে। পরে জানা যায়, হামলা হয়েছে দুটি মসজিদে। স্থানীয় সময় দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকতে হয়েছে তাঁকে। কারণ পুরো শহরই তখন অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। লকডাউন শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়, এরপর বাসায় ফিরতে পেরেছেন তিনি। চার ঘণ্টারও বেশি সময় চরম উৎকণ্ঠায় কেটেছে তাঁর। বাসায় ফিরতে পারলেও কাটেনি আতঙ্কের আবহ।
ক্রাইস্টচার্চেই স্ত্রী–সন্তান নিয়ে থাকেন মেজবাহউদ্দিন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে। তাঁর দুই ছেলেরই স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। দুপুর ১২টার কিছু পরে তাঁর স্ত্রী ছেলেদের নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন। এর পরই ঘটে মসজিদে হামলার ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার পুরোটা সময় তাঁর কেটেছে ফোনে। স্ত্রী–সন্তানদের খোঁজ নিয়েছেন, আত্মীয়–পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন ক্ষণে ক্ষণে।
ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশিদের সংখ্যা তুলনামূলক কম বলে জানান মেজবাহ। তিনি বলেন, সংখ্যাটি হবে ৩০০ থেকে ৫০০। তাঁর বাসাও হ্যাগলি পার্কের কাছে। হামলার পর বাসায় ফিরেও কিছুটা অবরুদ্ধ অবস্থাতেই আছেন সবাই।
মেজবাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সবাই খুব শকড। নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা নিকট অতীতে কখনোই দেখা যায়নি, ক্রাইস্টচার্চে তো আরও নয়। একমাত্র স্বস্তির বিষয় হলো, আমাদের ক্রিকেট দলের সদস্যরা অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। পুরো শহরেই এখন থমথমে অবস্থা।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মৃণ্ময় মৈত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্বে স্নাতকোত্তর শেষ করে ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবুরিতে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধায়। মেজবাহউদ্দিনের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় ‘লকডাউন’ হওয়ার আগ মুহূর্তে মসজিদে হামলার খবর পান মৃণ্ময়।
প্রথম আলোকে মৃণ্ময় বলেন, ‘আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি। এখানকার বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেশি নয়, কম–বেশি পরিচিত আছে। পরিচিত কয়েকজন এখন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আগামীকাল সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তার আবহ শুরু হয়েছিল আজ থেকেই। কিন্তু আজকের হামলার ঘটনায় সবই এলোমেলো হয়ে গেছে।’
এখন পুরো ক্রাইস্টচার্চ শহরে শোনা যাচ্ছে পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। সবাই পরিস্থিতি বুঝতে চোখ রাখছেন সংবাদমাধ্যমে। মৃণ্ময় বলেন, ‘জরুরি কাজ ছাড়া এখন কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। রাস্তাঘাট পুরোপুরি ফাঁকা। উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।’