গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর সেই হামলার তিন বছরের মাথায় নতুন মাত্রায় হুমকি হয়ে উঠেছে আইএসপন্থী জঙ্গিরা। শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার পর ঢাকায় পুলিশের ওপর এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে দুটি বোমা হামলা এবং আইএসের দায় স্বীকারের ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এখানকার জঙ্গিগোষ্ঠী।
তবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, হোলি আর্টিজানের মতো বড় ধরনের হামলা করার সামর্থ্য এখন নেই এখানকার জঙ্গিদের। তবে তারা চোরাগোপ্তা বা ‘লোন উলফ’ (একক ব্যক্তি বা জঙ্গিদের কোনো একটি ছোট দল) ধরনের হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে।
সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সর্বশেষ ঘাঁটির পতনের পর গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় ভয়ংকর জঙ্গি হামলাসহ বিভিন্ন দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে তাদের অনুসারীদের যেভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, তাতে এ দেশেও নতুন করে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। অনলাইনে আইএসপন্থীদের প্রচারণাতেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার এক সপ্তাহের মাথায় গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা (আইইডি) নিক্ষেপ করা হয়। বড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আইএস ওই হামলার দায় স্বীকার করে। এর এক দিন পর জঙ্গিদের নিজস্ব অনলাইন চ্যানেলে আইএসের আমির আবু বকর আল–বাগদাদির ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। তাতে বাগদাদি সিরিয়ার বাগুজ শহরে আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটির পতন ও পরাজয় মেনে নিলেও প্রতিশোধের হুমকি দেন। বাগদাদি শ্রীলঙ্কায় হামলাকে বাগুজ হারানোর প্রতিশোধ বলে দাবি করেন। এ–সংক্রান্ত জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের খবরে বলা হয়, বাগদাদির ওই বার্তায় বাংলাদেশে পুলিশের ওপর হামলার কথাও বলা হয়েছে।
এরপর গত ২৬ মে রাজধানীর মালিবাগে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে বোমা বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায়ও আইএস দায় স্বীকার করে। পরে আশপাশের সিসিটিভির চিত্র থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, ওই খালি পিকআপ ভ্যানে সময়নিয়ন্ত্রিত বোমাটি পেতে রাখা হয়েছিল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঙ্গিরা তিনটি উদ্দেশ্যে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে—এক. নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া, দুই. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তিন. আল-কায়েদা বা আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে বাংলাদেশে তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় আছে। তাই অবস্থান জানান দিতে তারা মাঝে মাঝে দু–একটা ঘটনা ঘটায়। তবে সম্প্রতি মালিবাগ ও গুলিস্তানের ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা আছে, নাকি এটার পেছনে তৃতীয় কোনো পক্ষের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে; সেটা নিয়ে আমরা তদন্ত করছি।’
এ দেশে আইএস মতাদর্শীর জঙ্গিগোষ্ঠী, যাদের পুলিশ ‘নব্য জেএমবি’ বলে থাকে, তারা প্রায় তিন বছর ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে দুটি হামলার মধ্য দিয়ে নিজেদের জানান দিল। এবারের ঈদুল ফিতরের সময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ধরনের হামলা হতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। এ নিয়ে ঢাকার কূটনৈতিক মহলেও উদ্বেগের সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। পরে ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঈদুল ফিতরের জামাতে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় কোনো অঘটন ছাড়াই সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
জঙ্গিগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও অনলাইনে তৎপরতা এবং গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সব কটি জঙ্গিগোষ্ঠীরই সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে তাদের পুনরায় সংগঠিত হওয়া ও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টাও রয়েছে।
অভিযানের মুখেও সক্রিয়
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার পর দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালায়। এসব অভিযানে হোলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি নিহত হয়। গ্রেপ্তারও হয়েছে অনেকে। ওই বছরে পুলিশ ও র্যাবের জঙ্গিবিরোধী নয়টি অভিযানে ৩৫ পুরুষ ও নারী জঙ্গি নিহত হয়েছে। পরের বছর ২০১৭ সালে সারা দেশে জঙ্গি আস্তানায় ১৮টি অভিযান হয়। এতে ৩৮ জঙ্গি ও তাদের সঙ্গে থাকা ছয় শিশুসন্তান নিহত হয়। এর মধ্যে সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযানের সময় জঙ্গিদের বোমায় র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ এবং পুলিশের দুই পরিদর্শক ও চারজন উৎসুক জনতা মারা গেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া সাত জঙ্গির জবানবন্দি থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে ব্যাপক অভিযানের সময়ও জঙ্গিরা দাওয়াতি কার্যক্রম, হালাকা (গ্রুপভিত্তিক পাঠচক্র) এবং অস্ত্র-বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য তৎপরতা চালায়। রাজধানীতেও এই কার্যক্রম চালায় তারা।
>হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে
বিভিন্ন দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করছে আইএস
এ দেশে নতুন করে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন
হোলি আর্টিজানের মতো হামলার সামর্থ্য এখন নেই এখানকার জঙ্গিদের
তবে জঙ্গিরা চোরাগোপ্তা ধরনের হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হোলি আর্টিজানের পর এত যে অভিযান হলো—ফলাফল কী? এ বিষয়ে মানুষকে কতটা সচেতন করা গেছে? কোরআন-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে জঙ্গিদের মতাদর্শ খণ্ডনের কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে?’ তিনি বলেন, এ ধরনের মতাদর্শভিত্তিক গোষ্ঠীকে মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি লাগে। এখানে সেটা নেই।
অনলাইনকেন্দ্রিক তৎপরতা
তবে এই জঙ্গিগোষ্ঠী মাঠপর্যায়ের চেয়ে অনলাইনে তাদের কথিত দাওয়াতি কার্যক্রম ও উগ্র মতবাদ প্রচারে বেশি সক্রিয়। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও তাই। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়া আড়াই শ জঙ্গির ওপর পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এসেছে, এদের ৮২ শতাংশই ইন্টারনেটে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই পথে এসেছে।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত র্যাবের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এখন কেনাকাটা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অনলাইনে হয়। জঙ্গিরাও তৎপরতা চালাচ্ছে অনলাইনে। সেখানে তাদের মোকাবিলা করা, ভুল ধরিয়ে দেওয়া, ধর্মের আলোকে তাদের যুক্তি খণ্ডন করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া সালাফি মতাদর্শের কিছু আলেমের ওয়াজও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণে একটা ভূমিকা রাখছে। এসব ওয়াজ ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে।
কতটা সামর্থ্য নব্য জেএমবির
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত পুলিশ ও র্যাবের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কর্মকর্তার মূল্যায়ন হচ্ছে, হোলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে আইএসপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীটি অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে নেতৃত্ব ও আর্থিক সংকটেও পড়ে তারা। তবে নব্য জেএমবিতে এখন কত সদস্য আছে, সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী অনলাইনে সক্রিয় আছে এমন সদস্যসংখ্যা অন্তত ২৫০ জন হবে। জঙ্গিদের অনেকে চুপচাপ ঘাপটি মেরে আছে। সংগঠনের ডাক পেলে সক্রিয় হতে পারে। এ ছাড়া ৮-১০ জনের একটি গ্রুপ কথিত হিজরতের নামে বাড়ির বাইরে আছে, যাদের নেতৃত্বে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক জঙ্গি। এই গ্রুপ উদ্বেগের একটা কারণ।
জানা গেছে, প্রবাসীদের একটি অংশ জঙ্গিদের মতবাদ সমর্থন করে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আর্থিক সহায়তা পায়। তারা প্রবাসে দুস্থদের সহায়তা ও রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য চাঁদা তুলে সেই টাকাও জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে পাঠাচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সন্ত্রাসবাদবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি রয়ে গেছে। তবে ডিএমপি কমিশনার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো হুমকি নাই। তবে আমরা তো বটেই, প্রত্যেক নাগরিকের অত্যন্ত সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ, এই সমস্যা আমাদের একার নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
লোন উলফ হামলার শঙ্কা
১৮ জুন পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআইয়ে ‘লোন উলফ’ হামলার আশঙ্কার উল্লেখ করা হয়। এ জন্য কেপিআইয়ের নিরাপত্তা আরও জোরদার করার তাগিদ দেওয়া হয়।
এর আগে গত এপ্রিলে জঙ্গিরা টেলিগ্রাম অ্যাপভিত্তিক একটি প্রচারণা চ্যানেলে ‘লোন উলফ’ নামে বাংলা ভাষায় একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। তাতে লোন উলফ আক্রমণের কলাকৌশল ও লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। এরপর গত মাসে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টার্গেট করেছে জঙ্গিরা। সারা বিশ্বে জঙ্গিরা এখন ‘লোন উলফ’ পদ্ধতিতে হামলা চালাচ্ছে। অর্থাৎ দলবদ্ধ হামলার চেয়ে একাকী হামলার প্রবণতা বাড়ছে। এই প্রবণতা রোধ করা প্রায় অসম্ভব। তিনি বলেন, জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব হয়নি। জঙ্গি বা সন্দেহভাজনদের নিয়ে মানুষ তথ্য দিলে ‘একাকী হামলা’র প্রবণতাও প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।