ধর্ষণের পরও ছাত্রাবাসে ছিলেন অভিযুক্তরা

  • জড়িত ছাত্রলীগের চার কর্মী গ্রেপ্তার।

  • ঘটনার পর ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার কাছে ভুক্তভোগীর গাড়ির চাবি ও ফোন ফেরত দেন আসামিরা।

সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর

সিলেটে ধর্ষণের শিকার তরুণী ও তাঁর স্বামীকে এমসি কলেজ ফটকের সামনে থেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আসামিরা। ঘটনাস্থলে শুরুতে চারজন আসামি ছিলেন। দুজন স্বামী-স্ত্রীকে আটকে রাখেন। একজন গাড়ি চালিয়ে ছাত্রাবাসে নেন। আরেকজন গাড়ির পিছু পিছু মোটরসাইকেলে করে যান।

তুলে নেওয়ার পর গাড়ি থেকে ছাত্রাবাস পর্যন্ত তিনটি স্থানে তরুণীকে নির্যাতন করা হয়। ঘটনার পর ধর্ষণকারীরা ছাত্রাবাসেই ছিলেন। তাঁরা তরুণী ও তাঁর স্বামীকে এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন। অবশ্য ভুক্তভোগী নববিবাহিত এই দম্পতির সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় এক ব্যক্তি, যিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। তিনি গিয়ে ধর্ষণকারীদের ছাত্রাবাসের ভেতরে দেখতে পান। তখন পুলিশ ছাত্রাবাসে ঢোকার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। এই ফাঁকে পালিয়ে যান আসামিরা।

সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে গত শুক্রবার রাতে তরুণীকে (১৯) ধর্ষণের ঘটনার এ বর্ণনা উঠে এসেছে তাঁর স্বামী (২৪) ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতার জবানিতে। তরুণীর স্বামী প্রথম আলোকে বলেছেন, স্ত্রীর ওপর নির্যাতনকালে তাঁকে আটকে রেখেছিলেন আসামিরা। তাঁরা ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আসামিরা তাঁর স্ত্রীর কানের দুল ও গলার চেইন ছিনিয়ে নেন।

ঘটনার পরদিন শনিবার তরুণীর স্বামী নয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। এর মধ্যে ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁদের মধ্যে চারজনকে গতকাল রোববার বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে প্রধান আসামি সাইফুর রহমানকে (২৮) সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে, অর্জুন লস্করকে (২৫) হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে এবং হবিগঞ্জ থেকে রবিউল ইসলাম (২৫) ও শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনিকে (২৫) গ্রেপ্তার করা হয়। বাকিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের সাতটি দল অভিযান চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার।

ভুক্তভোগী তরুণীর স্বামী শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে সাড়ে ১০টার দিকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) গিয়ে চিকিৎসাধীন স্ত্রীকে একনজর দেখে আসেন।

স্বামী ও এক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে ঘটনার বর্ণনা। স্বামীকে আটকে রেখে তরুণীকে তিনটি স্থানে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।

পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি সিলেটের পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলার বাসিন্দা। দেড় বছর আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। ফিরে একটি গাড়ি কেনেন (প্রাইভেট কার)। গাড়িটি মাঝেমধ্যে ভাড়া দেন ও নিজেরাও ব্যবহার করেন। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও আছে তাঁর।

তরুণ বিয়ে করেছেন তিন মাস আগে। সিলেট শহরে শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজের গাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। তিনি বলেন, ‘সাড়ে সাতটা-আটটার দিকে টিলাগড়ে এমসি কলেজের প্রধান গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে আমি দোকানে যাই খাবার কিনতে। সেখান থেকেই দেখছিলাম কয়েকজন তরুণ গাড়িতে উঁকি মারছেন।’

ওই তরুণ দ্রুত খাবার নিয়ে গাড়িতে ফেরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দুজন খাবার খাচ্ছিলাম, আর গল্প করছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন তরুণ আমাদের গাড়ি ঘিরে ধরেন। তাঁরা আমাদের পরিচয় জানতে চান, কী জন্য সেখানে গিয়েছি, তাও জানতে চান। বলি, আমরা স্বামী-স্ত্রী। তখন তাঁরা অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে আমাদের পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখান। আমরা আবারও জানাই যে আমরা স্বামী-স্ত্রী। একপর্যায়ে তিনজন জোর করে গাড়িতে উঠে বসেন। একজন চালকের আসনে বসে গাড়ি চালাতে শুরু করেন।’

ভুক্তভোগী তরুণ জানান, গাড়ি চালিয়েছিলেন তারেকুল ইসলাম। সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর গাড়িতে তাঁদের আটকে রেখেছিলেন। মোটরসাইকেলে পেছনে পেছনে এসেছিলেন শাহ মাহবুবুর রহমান। পরে ছবি দেখে এঁদের শনাক্ত করেন এবং নাম জানতে পারেন তিনি।

টিলাগড় এলাকা থেকে বালুচরের দিকে যে সড়কটি রয়েছে, সেটি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে। ভুক্তভোগী তরুণ বলেন, টিলাগড় পয়েন্ট থেকে সোজা বালুচরের দিকে যাওয়ার পর তাঁরা (আসামিরা) এক টানে গাড়িটি ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যান। ছাত্রাবাসের এক পাশে টিলা আছে। টিলার পাশে চারতলা ভবনের সামনে নিয়ে গাড়িটি রাখেন। এরপর আসামিরা ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। বলেন, টাকা দিলে ছেড়ে দেবেন।

তরুণ বলেন, ‘আমার কাছে দুই হাজার টাকা ছিল, সেটা তাঁদের দিয়ে বলি আর টাকা নেই। তাঁরা আমার স্ত্রীর কানের দুল ও গলার সোনার চেইন খুলে নেন। আমি বাধা দিতে গেলে মারতে থাকেন।’ তিনি জানান, ঘটনার একপর্যায়ে আরও কয়েকজন এসে যোগ দেন। তরুণীকে নির্যাতন করা হয় তিন দফায় তিনটি জায়গায়। দুর্বৃত্তরা কখনো গাড়ি থেকে স্ত্রীকে নামিয়ে ছাত্রাবাসের দিকে নিয়ে যান, আবার গাড়িতে এনে রাখেন, আবার নিয়ে যান।

তরুণীর স্বামী বলেন, ‘আমি তাঁদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে মাঝেমধ্যে জোরে জোরে কথা বলছিলাম। একসময় দেখি একটি ভবনের ছাদ থেকে কেউ একজন দেখছেন। তিনি নিচে নেমেছিলেন। পরে জেনেছি ওই ব্যক্তি একজন শিক্ষার্থী। তাঁকে ধমক দিয়ে হোস্টেলে পাঠান ধর্ষণকারীরা।’

নির্যাতনের পরও এই দম্পতিকে আরও ঘণ্টাখানেক আটকে রাখেন ধর্ষণকারীরা। তখনো বারবার টাকা চাইছিলেন তাঁরা। স্বামীটি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা আমাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। আমি বলেছিলাম, গাড়ি আপনারা রেখে দেন। আমাদের ছেড়ে দেন। তখন কয়টা বাজে মনে নেই। সব মিলিয়ে দু-তিন ঘণ্টা আমরা সেখানে ছিলাম।’

তরুণ প্রথম আলোর কাছে যখন ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন ভীত ও সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। আলাপস্থলের একটু দূরে কয়েকজন তাঁর ওপর নজর রাখছিলেন। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে গাড়ি রেখে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি স্ত্রীকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মূল সড়কে আসি। সড়কে একটি সিএনজির ড্রাইভারকে (সিএনজিচালিত অটোরিকশা) থামিয়ে কাকুতি-মিনতি করে ১০০ টাকা ধার চাই। কান্না দেখে চালক আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হন। আমার কাছে সিলেটের পুলিশ কমিশনারের নম্বর ছিল। আমার স্ত্রীর মোবাইল ফোন থেকে তাঁকে ফোন করি।’

সিলেটের পুলিশ কমিশনারকে আগে থেকে চিনতেন কি না জানতে চাইলে ওই তরুণ বলেন, ‘না, চিনতাম না। নম্বরটা কোনো কারণে ফোনে ছিল। পুলিশ কমিশনার ফোন ধরেন তৃতীয়বার কল করার পর। আমি তাঁকে ঘটনা বলি। কমিশনার বিষয়টি দেখা হবে ও প্রয়োজনে আমাকে কল দেওয়া হবে বলে জানান।’

ছাত্রাবাস থেকে শিবগঞ্জের দিকে আধা কিলোমিটারের মতো যাওয়ার পর টিলাগড় মোড়। সেখানেই অটোরিকশা থামিয়ে পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেছিলেন তরুণ। তাঁদের কান্না দেখে এগিয়ে আসেন টিলাগড়ের বাসিন্দা মিহিত গুহ চৌধুরী ওরফে বাবলা চৌধুরী। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বাবলা এখন ব্যবসা করেন। তাঁর কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন ভুক্তভোগী তরুণ। এরপর বাবলা চৌধুরী এই দম্পতিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। ভুক্তভোগী তরুণ বলেন, ‘তিনি (বাবলা চৌধুরী) বলছিলেন, যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’

‘আসামিরা ছাত্রাবাসেই ছিল’

বাবলা চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তরুণ-তরুণীর হাউমাউ করে কান্না দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে কারণ জানতে চান। এরপর শোনেন আসল ঘটনা। তিনি বলেন, ‘কথা বলার সময় তরুণের হাতে থাকা মোবাইলে একটি কল আসে। আমি ফোনটি নিয়ে কথা বলি। কণ্ঠ শুনেই চিনে ফেলি যে ছেলেটি সাইফুর। তরুণকে চলে যাওয়ার জন্য শাসাচ্ছিল সাইফুর। আমি তখন আমার পরিচয় দিয়ে বলি “আমি আসছি, দেখি তোরা কী করতে পারস”।’

বাবলা চৌধুরী জানান, তিনি এই দম্পতিকে নিয়ে ছাত্রাবাসের দিকে যান। কলেজ ফটকের সামনে গিয়ে শাহপরান থানার ওসিকে পরপর তিনবার ফোন করেন। ওসি জানান যে তিনি ঘটনাস্থলের পথে রয়েছেন। এরপর বাবলা চৌধুরী পুলিশ আসা পর্যন্ত ওই দম্পতিকে ফটকের সামনে তাঁর পরিচিত অন্য লোকদের সঙ্গে অপেক্ষা করতে বলেন। আর নিজে ছাত্রাবাসের ভেতরে যান। সেখানে গিয়ে সাইফুর, রবিউলসহ কয়েকজনকে দেখতে পান।

বাবলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে দেখে সাইফুর ওই দম্পতির গাড়ির চাবি ও মোবাইল ফোন তুলে দেয়। বলে যে এগুলো তারা ফেলে গেছে। তখন আমি কোনো কিছু না বলে চাবি ও ফোন নিয়ে ছাত্রাবাস গেটের দিকে যাই। আমি পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যাতে সবাইকে হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে পারি।’

বাবলা চৌধুরী আরও বলেন, ‘গেটে ফিরে দেখি ওসি কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সেখান থেকে একজন এসআইকে (পুলিশের উপপরিদর্শক) নিয়ে আবার ছাত্রাবাসে যাই। কিন্তু এরই মধ্যে আসামিরা সবাই পালিয়ে যায়।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় কয়েকজন ও পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে খবর পেয়ে তিনি এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ফটকে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা মোবাইল টিম প্রেরণ করেছিলাম। তারপর থানা থেকে আমি সেখানে গেলাম। ঠিক কতক্ষণ ছিলাম, যথাযথভাবে বলতে পারছি না। ছাত্রাবাসে প্রবেশের জন্য এক-দুবার ফোন করেছি। এই টুকু সময়ে আসামি পালিয়ে গেছে কি না, এটাও বলতে পারছি না।’

প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অব্যাহত

এই ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে গতকালও সিলেটে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা। ছাত্রাবাসের সামনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদের উদ্যোগে মানববন্ধন হয়। কলেজ ফটকে সিলেট জেলা ও এমসি কলেজ ছাত্রলীগ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মহানগর ছাত্রলীগ মানববন্ধন করে। প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এমসি কলেজে একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যারা এসব দুষ্কৃতকারীর গডফাদার, তাদেরও চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।