বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টন কয়লা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ কয়লা গত ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আত্মসাৎ করা হয়েছে। কয়লা আত্মসাতের জন্য বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) ২৩ কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়ী করা হয়েছে। আর পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই চুরির ঘটনা ঘটেছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) গঠিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। এর আগে সরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কয়লা চুরি হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার টন।
২০১৮ সালের আগস্টে এ কমিটি গঠন করা হয়। ১৮ মাস পরে বহুল আলোচিত বড়পুকুরিয়ার কয়লা চুরির ঘটনায় গঠিত নাগরিকদের এ কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করল। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি যৌথভাবে পাঠ করেন ছয় সদস্যর কমিটির সভাপতি লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। কমিটির সদস্য অধ্যাপক এম. শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বদরুল ইমাম, সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সুশান্ত কুমার দাস ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। উপস্থিতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ খোলাবাজারে কয়লা বিক্রির সময় আর্দ্রতা বা পানি ১০ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশের বেশি পানি যুক্ত কয়লা দেওয়া হয়। খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের পর সরাসরি তা বেল্টের মাধ্যমে পাশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎকেন্দ্রে চলে যায়। ফলে প্রথাগত লোকসান বা সিস্টেম লস হওয়ার সুযোগ নেই।
বড়পুকুরিয়ার কয়লাতে সর্বোচ্চ আর্দ্রতা (ইনহেরেন্ট ময়েশ্চার) রয়েছে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ চীনা প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে কয়লা নেওয়া হচ্ছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ আর্দ্রতায়। কিন্তু গড়ে বড়পুকুরিয়ার কয়লায় সাড়ে ১০ শতাংশ পানিসহ কয়লা গ্রহণ করেছে বিসিএমসিএল। ২০০৫ সাল থেকে খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরুর পর ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ টনের কয়লা দাম দিয়ে (১০ শতাংশ পানিসহ) মূলত কয়লা পেয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার টন। কিন্তু এই কয়লার হিসেবে বিসিএমসিএল রাখেনি। প্রতিবেদনে প্রথাগত সিস্টেম লস ১ লাখ ৬১ হাজার টন। এ হিসেবে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টন কয়লা চুরি হয়েছে।
আর বিসিএমসিএল ও পেট্রোবাংলার দাবি খোয়া যাওয়া ১ লাখ ৪৪ হাজার কয়লা প্রথাগত লোকসান। বেশি করে প্রথাগত লোকসান ধরার পরও চুরি যাওয়া কয়লার পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন যার হিসেব নেই খনি কোম্পানির কাছে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পিডিবি ছাড়া অন্য কারও কাছে কয়লা বিক্রি স্থায়ীভাবে বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া বড়পুকুরিয়ার কয়লায় পানি ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সংশোধন করা, কয়লার বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কাছে দেওয়া, বিসিএমসিএলের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) ও কল্যাণ তহবিল বিলুপ্ত সহ ১৩টি সুপারিশ করা হয়।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা খোয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করে বিসিএমসিএল। তখন বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করত বিসিএমসিএল। তখনই জানা যায়, খনির মুখে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লার হদিস নেই। এ ঘটনায় কয়লা ‘চুরি’ গেছে উল্লেখ করে মামলা করা হয়। এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, খোয়া যাওয়া কয়লা খনি কর্মকর্তারাই আত্মসাৎ করেছেন। এসব কয়লা খনির গেট দিয়ে ট্রাক করে বেরিয়ে গেছে। অভিযোগপত্রে কয়লা আত্মসাতের জন্য খনির সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়ী করা হয়েছে।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা তোলার কাজটি করে চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম। এই কনসোর্টিয়ামকে গত ১৩ বছরে (২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত) ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা তোলার বিল দিয়েছে বিসিএমসিএল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে খনি কর্তৃপক্ষ আরও পাঁচ লাখ ৪৮ হাজার টন বেশি কয়লা পেয়েছে। এ কয়লার বর্তমান দাম প্রায় ৯২৭ কোটি টাকা (খোলাবাজারে প্রতি টন কয়লার দাম ১৬ হাজার ৯২৭ টাকা)। এই টাকা খনি কোম্পানির তহবিলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে যে যেভাবে পেরেছে লুট করেছে। এই লুটের বেশ কিছু স্তর রয়েছে। এর সঙ্গে রাঘব বোয়ালরা জড়িত। কয়লা চুরি হয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ কিন্তু সরকারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার হিসাব মিলছে না।