নামে–বেনামে ঢাকায় ১১টি ফ্ল্যাট, প্লট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং পর্তুগাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও নেপালে সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত। সম্পদের খোঁজ শুরু।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে।
দেশ ছেড়ে পালানোর পর ভারতে গ্রেপ্তার ঢাকার বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানার বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। নামে-বেনামে থাকা তাঁর সম্পদের মধ্যে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ৫টি ফ্ল্যাট, ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভবনে জায়গা (স্পেস), ২টি প্লট ও ৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরও চারটি দেশে তাঁর সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে।
শেখ সোহেল রানা বছর চারেক আগে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হন। এর আগে তিনি দীর্ঘদিন গুলশান ও বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। তাঁর এত বিপুল সম্পদের কথা শুনে পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিস্মিত। পুলিশ সূত্র জানায়, সোহেল রানার অর্থসম্পদের খোঁজে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান গতরাতে প্রথম আলোকে জানান, সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
এই সোহেল রানা আলোচনায় আসেন গত আগস্টের মাঝামাঝিতে, ই-অরেঞ্জ নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হওয়ার পর। ওই মামলায় তাঁর বোন সোনিয়া মেহেজাবিন ও ভগ্নিপতি মাসুকুর রহমান এখন কারাগারে। তাঁর চতুর্থ স্ত্রী নাজনীন নাহার (বীথি) পলাতক। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার ই-অরেঞ্জের আরেক গ্রাহকের মামলায় আসামি করা হয় সোহেল রানাকে। ওই রাতেই তিনি পালিয়ে যান। এরপর গত শুক্রবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্দায় তিনি ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কোচবিহারের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে শনিবার ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেখ সোহেল রানা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই থাকাকালে কূটনৈতিক অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলেও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
গুলশানের পর সোহেল রানা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসবিতে ছিলেন। এরপর চার মাস কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমে ছিলেন। গত বছরের ২৮ মে থেকে বনানী থানায় পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
ই-অরেঞ্জের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলা দুটি তদন্ত করছেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আমিনুল ইসলাম। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে শেখ সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরদিন তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালান। তিনি বলেন, সোহেল রানার অর্থসম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ তাঁর দেশে-বিদেশে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ফ্ল্যাটের তথ্য পেয়েছে। এখন আদালতের মাধ্যমে সোহেল রানার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হবে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ই-অরেঞ্জের অপকর্মে জড়িত। তাঁর চতুর্থ স্ত্রী নাজনীন নাহার ও বোন সোনিয়া মেহেজাবিনকে টাকা দিয়ে ই-অরেঞ্জ চালাতেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও পুলিশের গুলশান বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেখ সোহেল রানার গুলশানের শাহজাদপুরের সুব্যস্তু নজরভ্যালির ৩ নম্বর টাওয়ারে একটি ও গুলশান মডেল টাউনে একটি, নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই ব্লকে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। গুলশানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ৯ কোটি টাকায় স্পেস কিনেছেন। বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে দুটি প্লট এবং গুলশানে ও উত্তরায় তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঢাকার বাইরে নিজ জেলা গোপালগঞ্জ ও খাগড়াছড়িতেও জমি কিনেছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া থাইল্যান্ডের পাতায়ায় সুপারশপ, জমি ও ফ্ল্যাট, পর্তুগালের লিজবনে সুপারশপ, বার ও রেস্তোরাঁ, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বার এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে বার ও ক্যাসিনো রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি স্থলপথে ভারত হয়ে নেপাল যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও বর্তমানে সরকারদলীয় সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বোঝা যায় তদারকি কর্মকর্তাদের শৈথিল্যের কারণে এই পুলিশ কর্মকর্তা এত কিছু করতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘আমার একটাই প্রশ্ন, যাঁরা তদারকি করবেন, তাঁদেরও তো দায়ভার থাকা উচিত। এটা না হলে তা চলতেই থাকবে।’