হোলি আর্টিজানে হামলা ৫ বছর

তিন জঙ্গিগোষ্ঠীর দুটি চলে বিদেশ থেকে

দুটি সংগঠনের নেতারা বিদেশে থেকে অনলাইনে সদস্য সংগ্রহ ও উগ্রবাদ ছড়াচ্ছেন। অপর সংগঠনের মূল নেতারা দেশে থেকেই তৎপর।

সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড না থাকলেও দেশে জঙ্গিদের প্রায় সব সংগঠনই কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় আছে। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে প্রতিটি সংগঠন সদস্য সংগ্রহসহ নানা তৎপরতা চালু রেখেছে। এর মধ্যে আলোচিত তিনটি জঙ্গি সংগঠনের দুটি পরিচালিত হচ্ছে বিদেশ থেকে। অপর সংগঠনের নেতারা দেশের ভেতরেই আছেন। ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার পর থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো কোণঠাসা অবস্থায় আছে। আজ ওই হামলার পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনাকালে মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের বেশির ভাগ সময় ঘরে থাকতে হচ্ছে। তাই লম্বা সময় অনলাইনে যুক্ত থাকছেন তাঁরা। উগ্রবাদ ছড়ানো ও সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো একে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে। গত দেড় বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাঁদের গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের বড় অংশও অনলাইনে সক্রিয় ছিলেন।

জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে যুক্ত বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সক্রিয় সংগঠনগুলোর মধ্যে যে তিনটি আলোচিত, সেগুলো হলো আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী নব্য জেএমবি এবং আল–কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণকারী জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম। জেএমবি ও নব্য জেএমবির মূল নেতারা বিদেশে থেকে সংগঠন পরিচালনা করছেন। আনসার আল ইসলামের নেতারা দেশেই আছেন বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এর বাইরে দেশের সবচেয়ে পুরোনো জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এর পুরোনো কিছু সদস্য ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক আরেকটি সংগঠন আল্লাহর দল। একসময় তারা জেএমবির সহযোগী ছিল। তাদের তেমন সাংগঠনিক সামর্থ্য নেই।

আফগানিস্তানে তালেবানদের পুনরুজ্জীবন সরাসরি প্রভাব ফেলবে এ দেশের জঙ্গিদের ওপর।
এ এন এম মুনিরুজ্জামান, প্রেসিডেন্ট, বিআইপিএস

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে হামলায় অভিযুক্ত জঙ্গিরা ছিলেন নব্য জেএমবির সদস্য। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) উত্থান ছিল তখন এই জঙ্গিদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। হোলি আর্টিজানের ওই হামলায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি ২২ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানে নব্য জেএমবির সাংগঠনিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। সিটিটিসির হিসাবে, তখন ২৬টি বড় অভিযানে নব্য জেএমবির ৬৩ জঙ্গি নিহত হন। এর আগে–পরে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৯৩ জন। কাছাকাছি সময়ে ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের পতনের কারণে নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎসও নষ্ট হয়ে যায় সংগঠনটির।

কিন্তু এখন আফগানিস্তানে তালেবানের নতুন উত্থান নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, এ দেশে জঙ্গিদের বড় অংশ শুরু থেকেই আফগানমুখী বা তালেবানি চিন্তাধারায় প্রভাবিত। আবার ইরাক-সিরিয়ায় পতনের পর আইএসের একটা অংশ আফগানিস্তানমুখী হয়েছে। তারা সেখানে সফল হলে সেটা আবার এখানকার আইএসপন্থীদের উৎসাহিত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

অভিযান অব্যাহত

র‍্যাব ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৫১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ১৯৯ জনই আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। ১৭৯ জন জেএমবির সদস্য। এই দুই সংগঠনের ৯ জন আত্মসমর্পণও করেছেন এ সময়।

পুলিশের অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গত বছরের শুরু থেকে গত ২৮ জুন পর্যন্ত ৬২টি অভিযানে ৯৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তাঁদের ২৭ জন গ্রেপ্তার হন। এই সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটও (সিটিটিসি) অনেককে গ্রেপ্তার করেছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ–ও বলেছে, নব্য জেএমবি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন নামে গ্রুপ খুলে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। আবার যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছে বিভিন্ন অ্যাপ। মূলত সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে কিছু নেতা কার্যক্রম চালু রেখেছেন। এই দুই দেশে বিভিন্ন শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে এঁরা অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন। এঁরা ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ও খুলনায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও বোমা পেতে রাখার ছয়টি ঘটনা ঘটান।

র‍্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন মঙ্গলবার বলেছেন, হোলি আর্টিজানে হামলার পর প্রায় দেড় হাজার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এখন জঙ্গিরা খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে। যখনই তারা কোথাও তৎপর হতে চেষ্টা করছে, আগাম তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

জেএমবি-আনসার আল ইসলামের নৈকট্য

আইএসপন্থী নব্য জেএমবির মতো পুরোনো জেএমবিও পরিচালিত হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। পুরোনো জেএমবির নেতৃত্ব মূলত সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিনের হাতে। ২০১৪ সালে প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গিরা তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। গত কয়েক বছরে তাঁর নেতৃত্বে ভারতে জেএমবির সাংগঠনিক বিস্তার ঘটেছে বলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, পুরোনো জেএমবি সদস্যদের বড় অংশ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার। সালাহউদ্দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক নতুন গ্রুপ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন।

একই সূত্র জানায়, সালাহউদ্দিন গত কয়েক বছরে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। মতাদর্শগত মিলের কারণে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে পুরোনো জেএমবির যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। আল-কায়েদা মতাদর্শী আনসার আল ইসলাম নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে থাকে। জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত সরকারি সংস্থার একটি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যা জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের যৌথ হামলাও হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। দুই সংগঠনের ওয়েব পেজের ডিজাইনও একই রকম।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, কারাগারে জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আছেন। সেখানে উভয় সংগঠনের মধ্যে একটা যোগাযোগ, সমন্বয় গড়ে উঠেছে। এঁরা যৌথভাবে নাশকতায় নামলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হবে।

২০০৮ সালে জন্ম নেওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সালে ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। তবে গত পাঁচ বছরে সংগঠনটির দৃশ্যমান তৎপরতা বা কোনো নাশকতার খবর পাওয়া যায়নি। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, এ মুহূর্তে দেশের অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনায় আনসার আল ইসলাম সবচেয়ে সংগঠিত। এর সদস্যদের বেশির ভাগ শিক্ষিত এবং অনেকে প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। তারা ঘাপটি মেরে আছে। সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসিমুদ্দীন রাহমানী প্রায় সাত বছর ধরে কারাগারে। তাঁর অনুপস্থিতিতে সংগঠনের অপারেশনাল কার্যক্রম চালাচ্ছেন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক, যিনি মেজর জিয়া নামে পরিচিত। তিনি আনসার আল ইসলামের কথিত সামরিক শাখার প্রধান। তাঁকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

জানা গেছে, আনসার আল ইসলাম বিভিন্ন অ্যাপে গ্রুপ খুলে নিজস্ব যোগাযোগব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনেও সদস্য ও সমর্থক বৃদ্ধির চেষ্টায় আছে। এরা অনলাইনে উগ্রবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বেশি সক্রিয়।

অ্যান্টিটেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) প্রধান, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড সাইবার প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। যখনই যাকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে, আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। দেশে এ মুহূর্তে বড় কোনো হামলা করার সামর্থ্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর নেই বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

তবু উদ্বেগ আছে

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। বিশেষ করে যেসব বাংলাদেশি আইএসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়া বা আফগানিস্তানে গেছেন, তাঁরা দেশে নতুন করে কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করেন কি না, বা তাঁদের কেউ নব্য জেএমবির হাল ধরেন কি না; এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সিরিয়া ও ইরাক গেছেন, তাঁদের বড় অংশই মারা গেছেন বা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন বলে জানা গেছে। কতজন এখনো মুক্ত আছেন, তার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফিরেছেন। সম্প্রতি এমন একজন চট্টগ্রামে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামানের মতে, জঙ্গিবাদ নিয়ে দেশে উদ্বেগ থাকবেই। তিনি প্রথম আলোকে তাঁর তিনটি উদ্বেগের কথা জানান। প্রথমত, করোনার কারণে তরুণেরা প্রচুর সময় অনলাইনে থাকছেন। জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা সাইবার পরিসরে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধকরণে বেশি আগ্রহী, তারা এ সুযোগ কাজে লাগাবে।

দ্বিতীয় উদ্বেগ আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুজ্জীবন। এ এন এম মুনিরুজ্জামানের মতে, এর সরাসরি প্রভাব এখানেও পড়বে। কারণ, বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের সূত্রপাত যে সংগঠনের মাধ্যমে, তার জন্ম হয়েছিল আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের মাধ্যমে। তাদের উত্তরসূরিরাও সব সময় আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে তালেবানের পুনরুজ্জীবন হলে তাদের এদেশীয় অনুসারীরা নতুন করে উৎসাহ পাবে।