নড়াইলের ছেলে তুর্কি মুন্নার বন্ধু মো. রহমত। ঢাকায় তাঁর কাছেই আসছিলেন তুর্কি মুন্না (১৮)। গাবতলীতে নামার পর রহমতের সঙ্গে দুইবার কথা বলেন মুন্না। রহমত প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাবতলীতে বাস থেকে নামার পর মুন্না আমাকে ফোন দিয়েছিল। বলেছিল, সে ঢাকায় পৌঁছেছে। আমার বাসায় আসছে। পরে না আসায় আমি তাকে ফোন দিচ্ছিলাম বারবার। তার মোবাইল ফোন বেজেই যাচ্ছিল। পরে জানতে পারি, মুন্নাকে খুন করা হয়েছে।’
রাজধানীর শাহ আলী এলাকায় ১৮ নভেম্বর ভোরে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেন মুন্নাকে। মুন্নার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবেন। ১৫ দিনের ব্যবধানে ঢাকার সড়কে দুইবার তিনি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। প্রথমবার প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর মুঠোফোন ও সার্টিফিকেট নিয়ে যান ছিনতাইকারীরা। আর দ্বিতীয়বার ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন তিনি।
আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। করোনার কারণে যেহেতু উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা হচ্ছে না, তাই সে পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় থেকে আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। ঢাকায় তার বন্ধু রহমতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঢাকাতেও গিয়েছিল। কিন্তু ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল এবং সার্টিফিকেট নিয়ে নেয়। আবার নড়াইলে এসে সার্টিফিকেটের নকল কপি তুলে ঢাকায় গিয়েছিল সেদিন। শেষ যখন তার সঙ্গে কথা হয়, তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা। ছেলে বলেছিল, তার মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফোন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাসায় পৌঁছে ফোন দেবে। পরে পুলিশের কাছ থেকে খবর পেলাম, আমার ছেলে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেশাহানারা বেগম, তুর্কি মুন্নার মা
পুলিশ বলছে, সেদিন মুন্না রাত আটটার দিকে ঢাকার উদ্দেশে নড়াইল থেকে বাসে করে রওনা দেন। দিবাগত রাত চারটার দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নামেন। এরপর বন্ধু রহমতের বাসায় যাওয়ার জন্য তিনি হাঁটছিলেন। ভোর পাঁচটার দিকে ছিনতাইকারী দল তাঁকে ঘিরে ধরে। তাঁর কাছে থাকা জিনিসপত্র নিতে বাধা দিলে ছিনতাইকারীদের একজন তাঁর বুকে ছুরি মারেন। সেখানেই লুটিয়ে পড়েন তুর্কি মুন্না। পরে তাঁকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
তুর্কি মুন্নাকে খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে শাহ আলী থানার পুলিশ। এর মধ্যে তিনজন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেদিন রাতে কীভাবে তুর্কি মুন্নাকে খুন করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহ আলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মুন্না খুনের সঙ্গে জড়িত ছয়জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও দুজন পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাঁরা সবাই পেশাদার ছিনতাইকারী।
কীভাবে সেদিন তুর্কি মুন্নাকে খুন করা হয়, সে ব্যাপারে শাহ আলী থানার পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুর্কি মুন্না যখন মিরপুর ১ নম্বর পদচারী–সেতুর নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন ছিনতাইকারীরা ছিলেন অটোরিকশায়। মুন্না যখন আকবরিয়া মসজিদের ১ নম্বর গেটের সামনে আসেন, তখন তিনজন ছিনতাইকারী মুন্নাকে ঘিরে ধরেন। তাঁর কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ছিনতাইকারীরা। তাতে বাধা দেন মুন্না। তখন মুন্নার বুকে ছুরি চালিয়ে দেন ছিনতাইকারী ওমর ফারুক।
তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংঘবদ্ধ এই ছিনতাইকারী চক্রের প্রধান হলেন ওমর ফারুক। তাঁর সহযোগীরা হলেন রাসেল (২৩), রাসেল শিকদার (২১), শাকিল (১৯), শাহিন, রাজীব, আরিফ ও রাকিব। তাঁদের মধ্যে শাহিন আর রাজীব ছাড়া সবাই ধরা পড়েছেন।
পুলিশ ও আদালত সূত্র বলছে, তুর্কি মুন্নাকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তিন আসামি। তাঁরা হলেন রাসেল, রাসেল শিকদার ও শাকিল। আর পুলিশি হেফাজতে আছেন প্রধান আসামি ওমর ফারুক, রাকিব ও আরিফ।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তুর্কি মুন্নার বাবা মো. জাকারিয়া সৌদিপ্রবাসী। মা শাহানারা বেগম গৃহিণী। তিনি থাকেন নড়াইল। মুন্নার দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। নড়াইলের স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর মুন্না সৈয়দপুর সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। মুন্না জেএসসিতে এ প্লাস ও এসএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ–৪.৮৩। করোনা মহামারি শুরুর পর তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। তাঁর বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার আগ্রহ ছিল আগে থেকে। তাই ঢাকায় থেকে আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
তুর্কি মুন্না খুন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা খবর পেয়ে সেখানে হাজির হই। পরে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খুন হওয়ার ৯ দিনের মধ্যে ৬ জন ছিনতাইকারীকে ধরা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন রিকশাচালকমতিউর রহমান, পুলিশ কর্মকর্তা
তুর্কি মুন্নার মা শাহানারা বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। করোনার কারণে যেহেতু উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা হচ্ছে না, তাই সে পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় থেকে আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। ঢাকায় তার বন্ধু রহমতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঢাকাতেও গিয়েছিল। কিন্তু ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল এবং সার্টিফিকেট নিয়ে নেয়। আবার নড়াইলে এসে সার্টিফিকেটের নকল কপি তুলে ঢাকায় গিয়েছিল সেদিন। শেষ যখন তার সঙ্গে কথা হয়, তখন রাত বাজে সাড়ে তিনটা। ছেলে বলেছিল, তার মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফোন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাসায় পৌঁছে ফোন দেবে। পরে পুলিশের কাছ থেকে খবর পেলাম, আমার ছেলে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছে।’
পুলিশ কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, ‘তুর্কি মুন্না খুন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা খবর পেয়ে সেখানে হাজির হই। পরে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খুন হওয়ার ৯ দিনের মধ্যে ৬ জন ছিনতাইকারীকে ধরা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন রিকশাচালক।’
মুন্না খুন হওয়ার পর তাঁর বাবা জাকারিয়া সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা আমার নিরীহ ছেলেকে খুন করল, তাদের ফাঁসি চাই।’