তরুণীকে তুলে নিয়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ‘ছাত্রলীগের কক্ষের’ সামনে গণধর্ষণ

শুক্রবার রাতে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে নিজেদের গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন স্বামী–স্ত্রী। পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে তাদের নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে গাড়িতে আটকে রাখেন দুজন। ঘণ্টাখানেক পর স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পান স্বামী।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার রাতে সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে এ ঘটনা ঘটে। করোনা পরিস্থিতিতে ছাত্রাবাস বন্ধ ছিল। তবে ছাত্রাবাসের ওই কক্ষ ২০১২ সাল থেকে ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ উঠেছে, ওই কক্ষে থাকা ছাত্রলীগের একটি পক্ষের ৬-৭ জন কর্মী এ ঘটনায় জড়িত।
খবর পেয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার একদল পুলিশ সেখানে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে উদ্ধার করে। এ সময় অভিযুক্ত ধর্ষকদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ফেলে যাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আর ওই দম্পতির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত গাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মোহা. সোহেল রেজা প্রথম আলোকে বলেন, স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন যুবক তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসের নির্জন স্থানে ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণকারীদের শনাক্ত করে আটক করতে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।

শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে যোগাযোগ করলে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার রাত তিনটা থেকে ছাত্রাবাসসহ আশপাশের এলাকায় অভিযান হয়েছে। ধর্ষণকারী শনাক্ত ও গ্রেপ্তার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। তিনি জানান, ওই তরুণীকে রাত ১২টার দিকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা মোটরসাইকেলটির মালিকের সূত্র ধরে ধর্ষণকারী শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

ছাত্রাবাসে নিয়মিত যাতায়াতকারী ছয়জন সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এই ছয়জনের বাড়ি হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জের দিরাই ও জগন্নাথপুরে। তাঁরা এমসি কলেজের সাবেক ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী।
শাহপরান থানা-পুলিশ সূত্র

ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্য, ওই তরুণীর (২০) বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। স্বামীর সঙ্গে নিজেদের গাড়িতে করে শুক্রবার বিকেলে এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়িটি রেখে একটি দোকান থেকে তাঁরা কেনাকাটা করেন। পরে ফিরে গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন তাঁরা। রাত আটটার দিকে পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে স্বামী ও স্ত্রীকে জোর করে গাড়ি থেকে নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে তখন গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন দুজন যুবক। ঘণ্টাখানেক পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে গিয়ে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান।

২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জের ধরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছিল ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পুনর্নির্মিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে ছাত্রলীগই এককভাবে ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্রদের বসবাস নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।

এমসি কলেজের একজন শিক্ষক ও ছাত্রাবাসের পাশের আবাসিক এলাকার দুজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বামীর চিৎকার শুনে বালুচর এলাকা থেকে কিছু লোক এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের দিকে নজর রাখছিলেন। একপর্যায়ে নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনে ছাত্রাবাস পার্শ্ববর্তী স্টাফ কোয়ার্টার থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পান। ছাত্রাবাস ফটকের সামনে তখন তাঁদের গাড়িটি ছিল। এক পাশে একটি মোটরসাইকেল রাখা দেখে স্থানীয় লোকজন শাহপরান থানায় খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্বামী-স্ত্রী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেন।

তরুণীর স্বামী পুলিশকে বলেছেন, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তাঁরা সংখ্যায় পাঁচ থেকে ছয়জন ছিলেন। এর মধ্যে দুজনকে তিনি এমসি কলেজ ও ছাত্রাবাসে আগে দেখেছেন। এই দুজন তাঁকে নিজের গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন। তিন থেকে চারজন তাঁর সামনে স্ত্রীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকে নিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর ওই তিন যুবক দৌড়ে চলে যাওয়ার সময় তাঁকে জিম্মি করে রাখা দুই যুবকও পালিয়ে যান।
এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল পুলিশ ছাত্রাবাসে প্রবেশের অনুমতি চায়। আমি তখন ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়কসহ স্টাফ কোয়াটারে বসবাসরত দুজন শিক্ষককে সঙ্গে কথা বলে পুলিশকে ছাত্রাবাস এলাকায় প্রবেশ করার অনুমতি দিই। কিছুক্ষণ পর জানানো হয়, সেখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ খবর পেয়ে আমি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব-৯) একটি দলকেও খবর দিই। পুলিশের সঙ্গে র‌্যাবের একটি দল তদন্ত করছে।’

করোনা পরিস্থিতির কারণে ছাত্রাবাস বন্ধ। শুনেছি নেতারা (ছাত্রলীগ নেতা) সেখানে ছিল। এর বাইরে আর কিছু আমি জানি না। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনতে পুলিশ ও র‌্যাবকে বলেছি।
অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ, এমসি কলেজ

১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এমসি কলেজ বাংলাদেশর অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নগরের টিলাগড় এলাকায় ৬০০ শতক জায়গার ওপর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আমলে আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জের ধরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছিল ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পুনর্নির্মিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে ছাত্রলীগই এককভাবে ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্রদের বসবাস নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। সিলেটে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিও কেন্দ্র থেকে স্থগিত রয়েছে। ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের কক্ষের সামনে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমসি কলেজ ও সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের দুজন সাবেক নেতা বলেন, ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের যে ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনার পর থেকে ৭ নম্বর ব্লকের কক্ষটি 'ছাত্রলীগের' হিসেবে পরিচিত। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর ছাত্রাবাস খোলার পর থেকে ওই কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের একাধিক পক্ষের সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই ছাত্রলীগের দুই পক্ষে আধিপত্য বিস্তারে ছাত্রাবাসে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। তখন প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ রাখার পর ওই বছরের ২৯ জুলাই ছাত্রাবাস খোলা হয়। গত বছরের ৬ আগস্ট রাতে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের কয়েকটি কক্ষ ও নতুন ভবন দখল তৎপরতার মুখে সর্বশেষ ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ২৫ মার্চ থেকে বন্ধ ছিল ছাত্রাবাস।

স্বামীকে আটকে রেখে কয়েকজন যুবক তাঁর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসের নির্জন স্থানে ধর্ষণ করেছেন। ধর্ষণকারীদের শনাক্ত করে আটক করতে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।
মোহা. সোহেল রেজা, সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ)

যে কক্ষের সামনে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি ছাত্রলীগের দখল করা কক্ষ কিনা—জানতে চাইলে অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে ছাত্রাবাস বন্ধ। শুনেছি নেতারা (ছাত্রলীগ নেতা) সেখানে ছিল। এর বাইরে আর কিছু আমি জানি না। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনতে পুলিশ ও র‌্যাবকে বলেছি।’
শাহপরান থানা-পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ছাত্রাবাসে নিয়মিত যাতায়াতকারী ছয়জন সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এই ছয়জনের বাড়ি হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জের দিরাই ও জগন্নাথপুরে। তাঁরা এমসি কলেজের সাবেক ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী। তাদের ধরতে শুক্রবার রাত তিনটা থেকে অভিযান চলছে। তবে পুলিশ কাউকে পায়নি।