ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শারমিন জাহান কীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহ করলেন, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আদালত।
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক মো. মইনুল ইসলাম আসামি শারমিন জাহানের কাছে জানতে চান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হয়ে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বিএসএমএমইউর মতো আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে মাস্ক সরবরাহ করতে পারেন কি না?
আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ নেত্রী শারমিন জাহান তখন নিরুত্তর ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা করছিলেন শারমিন জাহান। শিক্ষা ছুটিতে থেকে তিনি ব্যবসা করছিলেন। ২০১৬ সালে চীন সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উহান হোয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এইচইউএসটি) পিএইচডি করতে যান। কোভিড–১৯ শুরু হলে উহানে লকডাউনের পর গত ২৩ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. এনামউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের বাইরে খণ্ডকালীন কোনো কাজ বা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে অনুমতি নিতে হয়। শারমিন জাহান এমন কোনো অনুমতি নেননি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে রেজিস্ট্রার বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
আজ দুপুরে কড়া নিরাপত্তায় মধ্যে শারমিন জাহানকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়। তখন রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান আসামি শারমিন জাহানের কাছে জানতে চান, ‘আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করেন কি না?’
জবাবে শারমিন বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরি করি।’
শারমিনের কাছ থেকে এমন উত্তর পাওয়ার পর পিপি হেমায়েত উদ্দিন খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম চাকরি করে কোন কর্তৃত্ববলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন? রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নিয়ে আপনি কি নিজের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন?’
তখন শারমিন জাহান বলেন, ‘কেবল আমি নই, আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেকে একই কাজ করছেন। আমার দোষ কোথায়?’
তখন পিপি হেমায়েত উদ্দিন খান শারমিন জাহানের কাছে সুস্পষ্টভাবে জানতে চান, ‘কোন আইনের বলে আপনি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন?’
পিপি হেমায়েত উদ্দিন খান রিমান্ড শুনানির সময় আদালতের কাছে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার হয়েও আসামি নিজের নামে অবৈধ প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করেছেন। আসামির প্রতিষ্ঠানের কোনো লিগ্যালিটি নেই। আসামির সার্ভিস রুলে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো সুযোগ নেই। এটা তো পেশাগত মিসকন্ডাক্ট।’
নকল মাস্ক সরবরাহ করে প্রতারণার অভিযোগে বিসএমএমইউর করা মামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী শারমিনকে শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করে শাহবাগ থানার পুলিশ। আজ শারমিনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির তিন দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত শারমিনকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শারমিন এখন ডিবি হেফাজতে রয়েছেন।
শারমিন নিজে আদালতের কাছে দাবি করেছেন, তিনি গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি কোনো অন্যায় করেননি। নিয়ম মেনে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে মাস্ক সরবরাহ করেছেন। বিএসএমএমইউ নিজেরা স্বীকার করেছে, তার প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের মাস্ক প্রথম দুই দফা ভালো ছিল। তৃতীয় দফার মাস্কও প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণ করেছে। পরে যখন প্রতিষ্ঠানটি অভিযোগ করেছে, মাস্কগুলো নিম্ন মানের, তখনো তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে লিখিতভাবে জবাব দিয়েছেন। শারমিনের আইনজীবী কাজী মুহাম্মদ পনির হোসেনও আদালতের কাছে দাবি করেন, তাঁর মক্কেল ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি কোনো অন্যায় করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করার কথা বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছে লুকিয়েছিলেন বলে জানালেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করতেন, সেই বিষয়টি তিনি কখনো বলেননি। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি তাঁরা জানতেন না। প্রথম দুই দফা শারমিনের প্রতিষ্ঠান যে মাস্ক সরবরাহ করেছিল, তার মান ভালো ছিল। তবে তৃতীয়বার তাঁর প্রতিষ্ঠান যে মাস্ক সরবরাহ করে, তা ছিল নিম্ন মানের।
মামলার বাদী বিএসএমএমইউয়ের প্রক্টর মো. মোজাফফর আহমেদ বলেন, গত ২৭ জুন শারমিন জাহানকে ১১ হাজার মাস্ক সরবরাহের কার্যাদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। কার্যাদেশের বিপরীতে ৩০ জুন প্রথম দফায় ১ হাজার ৩০০টি; ২ জুলাই দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ৪৬০টি ও ১ হাজারটি এবং ১৩ জুলাই চতুর্থ দফায় ৭০০টি মাস্ক সরবরাহ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় লটের মাস্কে কোনো সমস্যা ছিল না। তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় লট বিতরণ ও ব্যবহারে ত্রুটি পাওয়া যায় এবং মাস্কের গুণগত মান স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। কোনো মাস্কের বন্ধনী ফিতা ছিঁড়ে গেছে, কোনো মাস্কের ছাপানো লেখায় ত্রুটিপূর্ণ ইংরেজি লেখা পাওয়া গেছে, কোনো কোনো মাস্কের নিরাপত্তা কোড ও লট নম্বর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে নকল বলে জানা গেছে।
সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন না শারমিন
শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী রেজিস্ট্রার হয়ে ব্যবসা করতে পারেন না বলে মত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দান করতে পারেন। শিক্ষা দান করে যে বেতন পাবে, তাঁর একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমা দিতে হয়। কিন্তু কোনো শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করা চাকরিবিধির পরিপন্থী এবং সেটা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। তবে আজকাল যেহেতু কেউ নিয়মকানুনের ধার ধারে না, কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই, একই ধরনের কর্মকাণ্ড অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী রেজিস্ট্রার হয়ে শারমিন জাহান নিজের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন না। এটা নৈতিকতার পরিপন্থী। আবার তাঁর বিরুদ্ধে বিএসএমএমইউর মতো প্রতিষ্ঠানে নকল মাস্ক সরবরাহ করার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী কোনোভাবে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারবেন না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি হবে তাঁর পেশাগত অসদাচরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম চাকরি করে তিনি কোনোভাবে ব্যবসা করতে পারবেন না।’
শারমিন জাহান সহকারী রেজিস্ট্রার হয়েও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কর্মচারী। অতএব আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। সে যে গ্রেডেই চাকরি করি না কেন? যারা খণ্ডকালীন তাদের কথা ভিন্ন। শারমিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নীতিবিরুদ্ধ কোনো কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্রয় দেয় না। এ ক্ষেত্রেও তা–ই হবে। শারমিন জাহানের কাগজপত্রগুলো দেখতে চেয়েছি। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসিক বেতনভুক কর্মচারী আমরা। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নিই। আমরা ফুলটাইম চাকরি করি। সুতরাং আমার তো ফুলটাইম দিতে হবে প্রতিষ্ঠানের জন্য।’