ঢাকায় বিস্ফোরণে নিহত ১ : আইএসের দায় স্বীকার

রাজধানীতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় পুলিশের তল্লাশিচৌকির কাছে গতকাল রাতে বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনাস্থলের চারপাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী l ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় পুলিশের তল্লাশিচৌকির কাছে গতকাল রাতে বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনাস্থলের চারপাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী l ছবি: প্রথম আলো

সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরুর ১৬ ঘণ্টার মাথায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় বিমানবন্দর সড়কের গোলচত্বরে পুলিশের একটি তল্লাশিচৌকির কাছে বোমা বিস্ফোরণে এক ব্যক্তি নিহত হন। আশকোনায় র্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার এক সপ্তাহের মাথায় এ ঘটনা ঘটল।
পুলিশ বলছে, সন্ধ্যা সাতটার দিকে এ বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত ব্যক্তির পেট ও কোমর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পুলিশের ধারণা, ওই ব্যক্তির পেটে বোমা বাঁধা ছিল। রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁর পরিচয় মেলেনি। এতে আর কেউ হতাহত হননি। এই ঘটনার পরপরই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল সড়ক থেকে বিমানবন্দর এলাকায় ঢোকার পথ থেকেই নিরাপত্তা জোরদারে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
গতকালের এই ঘটনাকে ‘আত্মঘাতী বোমা হামলা’ দাবি করে এর দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। এই গোষ্ঠীর কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক’ এই খবর দিয়েছে বলে জানিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
অবশ্য রাত পৌনে নয়টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘এটি হামলা নয়। লোকটি ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে ফুটপাত ধরে যাচ্ছিল। পুলিশের চেকপোস্টের কিছুটা দূরে থাকতেই লোকটির সঙ্গে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।’
পুলিশের চেকপোস্ট এড়াতে অতিসতর্কতা অবলম্বন করতে গিয়ে এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, ‘লোকটি বোমা বহন করে কোথাও নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার বয়স আনুমানিক ৩০-৩২ বছর। জিনসের প্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট পরা ছিল। তার পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তার কাছে একটি ট্রলিব্যাগ ছিল।’
এর আগে ১৭ মার্চ গতকালের ঘটনাস্থলের এক-দেড় শ গজ দূরে র্যাবের ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলা হয়। ওই ঘটনায়ও আইএস দায় স্বীকার করে। তবে বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই আইএসের দায় স্বীকারকে নাকচ করে দিয়ে আসছে।
গতকালের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পুলিশের তল্লাশিচৌকি ছাড়াও বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি, সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) ও ট্রাফিকের পেট্রল ইন্সপেক্টরের কার্যালয় অবস্থিত। সহকারী কমিশনারের (ট্রাফিক) কার্যালয়ে ছিলেন আনসার সদস্য বিল্লাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাতটা-সোয়া সাতটার দিকে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। বেরিয়ে দেখেন এক ব্যক্তি পড়ে আছেন রাস্তার পাশে। অদূরে রাস্তার পাশে একটি ট্রলিব্যাগ পড়ে আছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল গিয়ে ওই ট্রলিব্যাগ পরীক্ষা করে তিনটি বোমা পায়। রাত পৌনে ১১টার দিকে ওই বোমা তিনটি নিষ্ক্রিয় করে তারা। এতে বোমার স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে আশপাশের তিন রেস্তোরাঁকর্মী ও এক পথচারী আহত হন। বোমার আওয়াজে অজ্ঞান হয়ে পড়েন এক মাদ্রাসাছাত্র। বোমার স্প্লিন্টারে কয়েকটি গাড়ির কাচও ভেঙে যায়। মধ্যরাতের পর নিহত যুবকের লাশ ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয় পুলিশ।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার শিববাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটা থেকে একটি বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ। শুক্রবার বাড়ির বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। ছবিটি গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় তোলা l আনিস মাহমুদ

সিলেটে অভিযান
জঙ্গিরা অবস্থান করছে, এমন তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় একটি পাঁচতলা বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আট দিনের মাথায় পুলিশ সিলেটের এই জঙ্গি আস্তানার খবর পায়।
গতকাল দিনভর বারবার মাইকে আহ্বান জানিয়েও ভেতরে থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি পুলিশ। উল্টো ভেতর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। অভিযান চালাতে ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটের একটি দল গতকাল বিকেলে সিলেটে পৌঁছায়। গত রাত দুইটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সোয়াট ও স্থানীয় পুলিশ বাড়িটি ঘিরে রাখে। সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি যায়। পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, পুলিশকে সহায়তা দিতে সেনাসদস্যরা এসেছেন।
পুলিশের ধারণা, আতিয়া মহল নামের বাড়িটির নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা অবস্থান করছে। ভেতরে একজন নারী থাকার কথা নিশ্চিত হলেও মোট কতজন আছে, সেটা জানা যায়নি। তবে পুলিশের ধারণা, ভেতরে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাইনুল ওরফে মুসা আছে।
আতিয়া মহল নামে পাঁচতলা ওই বাড়িটিতে মোট ২৯টি ফ্ল্যাট রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সব ফ্ল্যাট থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া যায়নি। যাঁরা ভেতরে আটকা পড়েছেন, তাঁদের ঘরের ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে নিরাপদে অবস্থান করতে বলেছে পুলিশ।
গত রাতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওই ভবনটিতে এখনো অনেক লোক আটকা রয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলার ছায়ানীড় বাড়িটিতে অভিযানের যে অভিজ্ঞতা, তাতে জঙ্গিদের কাছে খুব শক্তিশালী বিস্ফোরক থাকতে পারে। সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে দোতলা বাড়ির ছাদের একটা অংশ ধসে পড়েছিল। যেহেতু এ বাড়িতে এখনো লোকজন আটকা আছে, তাই বড় বিস্ফোরণ হলে সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই ওই বাড়ি থেকে সবাইকে সরানোর আগে রাতের অন্ধকারে এ ধরনের অভিযান ঝুঁকিপূর্ণ। এ বারণে ঊর্ধ্বতন মহল থেকে ধৈর্য ধরে কাজ করতে বলা হয়েছে। সোয়াটের সদস্যরা সেভাবেই কাজ করবেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকনউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান ও তল্লাশি চালায় পুলিশ। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল দিবাগত রাতে শিববাড়ি এলাকায় সন্দেহজনক বাড়িটির সন্ধান পাওয়া যায়। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়াটেদের তথ্য নেওয়া হয়। পুলিশ নিশ্চিত হয়, বাড়ির নিচতলায় জঙ্গিরা অবস্থান করছে। এরপর বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ওই বাড়িটি শনাক্ত করে ঘিরে রাখা হয়। ভোররাত চারটার দিকে বাড়ির ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা ছোড়া হয়। পরে থেমে থেমে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। বাড়িটির চারদিক দেয়ালঘেরা। প্রধান ফটক আটকে রাখা হয়েছে। যার কারণে বাড়ির অন্য বাসিন্দারা আটকা পড়েন। গতকাল কিছু কিছু বাসিন্দাকে বের করে আনা হয়েছে। বাড়িটির দিকে যাওয়ার সড়ক জনসাধারণের চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ আশপাশের ভবনের ছাদে উঠে অস্ত্র তাক করে সতর্ক অবস্থান নিয়ে আছে।
আতিয়া মহলের মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী উস্তার আলী প্রথম আলোকে বলেন, গত জানুয়ারি মাসে একটি পরিবার নিচতলায় ওঠে। ভাড়াটিয়া ফরমে মর্জিনা বেগম নাম লেখা হয়। ওই বাড়ির কর্তা নিজেকে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।
গতকাল দুপুরের দিকে আতিয়া মহলের পেছনের একটি ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন বাড়ির একজন তত্ত্বাবধায়ক। তিনি জানান, বের হওয়ার আগে নিচতলার ওই ফ্ল্যাট থেকে নারী কণ্ঠে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক বলেন, যে ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা বসবাস করত, সেখানে দরজা-জানালায় সব সময় পর্দা ঝোলানো থাকত। ওই নারী বাসায়ও বোরকা পরে থাকতেন। ঘরে বাতি জ্বলত খুব কম। ঘরে একটি আলনা আর চেয়ার-টেবিল ছাড়া আসবাবপত্র ছিল না বললেই চলে।
সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া বলেন, এক নারীসহ কয়েকজন জঙ্গি ভেতরে আছে বলে তাঁরা মনে করছেন।