গত অক্টোবরে লুৎফুন্নাহারের বাড়িতে যে রাতে ডাকাতি হয়, সে রাতে তাঁর ভাশুরের মেয়ের মৃতদেহ ঢাকা থেকে এসে পৌঁছানোর কথা ছিল। বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন। এরই মধ্যে ডাকাতেরা সব লুটে নিয়ে যায়। সামনের রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছিল। পুলিশ আসে ডাকাতির পর। টুকটাক কথাবার্তা বলে চলে যায়, মামলা নেয় না।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলাজুড়ে এমন একটি করে ডাকাতি হয় আর প্রথম আলোর প্রতিনিধি সরেজমিনে ঘুরে এসে ক্যালেন্ডারে দাগ দেন। তারিখের মালায় গাঁথা হতে থাকে ডাকাতির স্মারক। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, গত বছর ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় বড় মাপের ডাকাতি হয়েছে ৩০টি। থানায় মামলার সংখ্যা কিন্তু মাত্র ২, আর পুলিশের মুখের কথায় ডাকাতির ঘটনা ‘জিরো’।
এ উপজেলায় এক রাতে দু-তিনটি বাড়িতেও ডাকাতি হয়েছে। রীতিমতো সশস্ত্র ডাকাতি। মানুষের মাল তো গেছেই, কখনো জানের ওপরও হামলা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর প্রথম আলোর প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে পুলিশের দেখা পেয়েছেন। গত বছর দুটি মামলাও কিন্তু হয়েছে, যার শেষেরটির বাদীর ভাই একজন সেনা কর্মকর্তা।
গত ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এই প্রতিবেদকেরা ডাকাতি হওয়া ১০টি বাড়িতে যান। ভুক্তভোগীরা বলেন, ডাকাতদের সঙ্গে পুলিশের সখ্য আছে। তাই তাঁরা মামলা করতে চান না। তা ছাড়া পুলিশ কোনো দিনও লুটের মাল উদ্ধার করতে পারবে না। উল্টো টাকা গচ্চা যাবে, নিরাপত্তা থাকবে না।
ঢাকায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা আবার বলেছেন, ডাকাতি হওয়ার অর্থ, পুলিশ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয় বলে পুলিশ ডাকাতির খবর চেপে যায়। তবে সোনাগাজী থানার পুলিশ এসব মানতে নারাজ। ওসি কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চৌহদ্দিতে ডাকাতি ‘জিরো’। প্রথম আলো গত বছরের দুটি মামলার কথা মনে করিয়ে দিলে ওসি বলেন, ওই ডাকাতিগুলোর পর তিনি ‘হইচই নোটিশ’ দিয়েছিলেন। মালামাল উদ্ধার হয়নি, তবে দু-তিনজন ডাকাত ধরা পড়েন।
প্রথম আলো যে ১০টি বাড়িতে গেছে, সব বাড়িতেই পরিবারের কেউ না কেউ প্রবাসে কাজ করেন। বাড়িতে থাকেন তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মা আর স্ত্রী-সন্তান। গ্রামের শান্ত, মনোরম পরিবেশে ছিমছাম একতলা-দোতলা সব বাড়ি। কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান এমনকি মৃতের সৎকারের জন্য সবাই যখন এক হন, জমি কেনার জন্য টাকাপয়সা পাঠান কিংবা টাকা জোগাড় করে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নেন, তখনই ডাকাতিগুলো হয়।
পুলিশ-ডাকাত ভাই ভাই?
সেনা কর্মকর্তার পরিবারের করা মামলায় সন্দেহভাজন আসামির তালিকায় ইউনিয়ন পরিষদের দুজন সদস্য আছেন। তাৎক্ষণিক হাতেনাতে ধরা পড়ার কয়েকটি ঘটনাতেও মামলা হয়নি। ধরা যাঁরা পড়েছেন, সবাই স্থানীয় লোকজন।
গত বছরের ১৫ এপ্রিল রাতে চরচান্দিয়া ইউনিয়নের এক গ্রামে সলিমউদ্দীনের বাড়িতে ডাকাতি হয়। রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে একদল ডাকাত ঘরে ঢুকে তাঁর ভাই, বোন ও বোনজামাইকে বেঁধে ফেলে। বোনজামাই বিদেশে যাবেন বলে আড়াই লাখ টাকা ঘরে ছিল। ডাকাতেরা সেই টাকাসহ ১৫ ভরি সোনার গয়না নিয়ে যায়।
সলিমউদ্দীন মামলা করতে পারেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সোনাগাজী থানার ওসি আমাদের বলল লিখিত অভিযোগ দিতে। দিলাম। বললাম, এজাহার হিসেবে রেকর্ড করেন। সে করব, করছি বলে শুধু ঘুরাইতেই থাকে। পরে বলে এসপির সঙ্গে দেখা করতে।’
সলিমউদ্দীন জেলা সদর ফেনীতে গিয়ে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর ভাষ্যমতে এসপি বলেন, ডাকাতির মামলা রেকর্ড হলে মুশকিল। তিনি যেন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নামগুলো লিখে দিয়ে যান।
সলিমউদ্দীন সদর থেকে সোনাগাজী ফিরলে ওই ব্যক্তিরা তাঁকে চেপে ধরেন। তাঁর প্রশ্ন হলো, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে ডাকাতদের সখ্য না থাকলে এরা তাঁর তালিকার কথা জানল কীভাবে? তিনি বলছেন, এরপরও মামলা দায়েরের চেষ্টা করলে ওসি টাকা চান।
এ বিষয়ে কয়েক দিন চেষ্টা করেও পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকার অথবা সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
চরকৃষ্ণজয়ের আবুল কাশেমের দুই ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন, আরেকজন সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট। গত বছরের ১২ জুলাই রাত দুইটার দিকে কাশেমের বাড়িতে ডাকাত পড়ে। মুখ বাঁধা ১২-১৩ জন ডাকাতকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি স্ত্রী চেমন আফরোজকে জাগিয়ে বলেন, ‘মেহমান এসে গেছে, চাবিগুলো দিয়ে দাও।’
ডাকাতেরা সবাইকে পিছমোড়া করে বেঁধে প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণালংকার আর ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। কাশেমের প্রবাসী এক ছেলে শাহ পরান সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পুলিশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা আরিফ, সাখাওয়াত হোসেন ও মাহফুজ আলমকে গ্রেপ্তার করে।
ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাঁরা তিনজন স্থানীয় দুটি ইউপির সদস্য মো. আরু মিয়া ও মো. গোলাম কিবরিয়ার (শামীম মেম্বার) নাম বলেন। তাঁরা সন্দেহভাজন আসামির তালিকায় ওঠেন।
দুজনেরই দাবি, তাঁদের ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরু মেম্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা ডাকাতি কইচ্চে আমরা দেখি ন। রাতের আন্ধারে আমনে কাউরে দেখতে ফাইবেননি?’ গোলাম কিবরিয়া বলেন, তাঁরা জনহিতৈষী কাজ করেন। সমাজে তাঁরা গণ্যমান্য। তাঁরা বরং ডাকাত ধরে দিয়েছেন।
কাশেমের এক ছেলে বলেছেন, এই দুজন এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন। সেনা কর্মকর্তার ছেলেটি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার চেয়ে গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত তাঁর দপ্তরের সুপারিশসহ এসপিকে চার দফা চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কেউ গ্রেপ্তার হননি।
পুলিশ যেভাবে ঘোরায়
যে রাতে সলিমউদ্দীনদের চরচান্দিয়ার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল, সে রাতে একই গ্রামের মো. রুহুল আমিনের বাড়িতেও ডাকাতি হয়।
গত ২৯ এপ্রিল রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, রাত আড়াইটার দিকে একদল ডাকাত তাঁদের বাড়িতে ঢোকে। ডাকাতদের সবার মুখে কাপড় বাঁধা, হাতে ঢাল আর কিরিচ। একজন বলেন, ‘আওয়াজ করিচ্চা। কাডি ফালামু।’
ডাকাতেরা বাড়ির সবাইকে বেঁধে ফেলে প্রায় ১৫ ভরি স্বর্ণালংকার, ১ লাখ টাকা আর ৫ লাখ টাকার জিনিসপত্র নিয়ে যায়। পাঁচজনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। সকালে পুলিশ এসে দেখে মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দুই ছেলে লম্বা সময় চট্টগ্রামের হাসপাতালে ছিলেন। তাঁদের একজনের বিদেশে যাওয়ার ভিসা আর টিকিট ছিল। যেতে পারেননি।
তবু পুলিশ মামলা নেয়নি। রুহুল আমিন বলেন, পুলিশ বলেছিল আগে ডাকাতদের শনাক্ত করতে হবে। ডাকাতদের মুখ ঢাকা থাকায় তাঁরা কাউকে চিনতে পারেননি। তাই মামলাও করতে পারেননি।
নমিতা বর্ধনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। গত বছরের ৭ নভেম্বর দিবাগত রাতে মতিগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর পালগিরি গ্রামে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে ডাকাত পড়ে। ডাকাতেরা যখন তাঁর ঘরে ঢোকে, ছোট ছেলেটিকে নিয়ে তিনি শুয়েছিলেন। ছেলেটির বুকের ওপর পা তুলে তাঁরা চাবি চান।
ডাকাতেরা তাঁর কাকাশ্বশুর এবং তাঁদের বাড়ি থেকে ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার আর ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। তাঁর আরেক কাকাশ্বশুর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী দুলাল বৈদ্য ভোররাতে থানায় ফোন করে বাড়িতে ডাকাতির কথা জানান। পুলিশ ভোরে এসে বলে ডাকাতদের চিনলে থানায় গিয়ে মামলা করতে। অথচ যে দুটি মামলা হয়েছে, সেখানেও আসামিরা অজ্ঞাতনামা।
ডাকাতি চলছেই
এ বছরের প্রথম চার মাসেও ছয়টি ডাকাতি হয়েছে। গত জানুয়ারিতে সুজাপুর, নদনা ও পৌরসভা এলাকার চরগণেশে এক রাতে তিনটি ডাকাতি হয়েছে। অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন। মানুষ আর পুলিশের ওপর ভরসা করে না।
চরলামছির আবদুল কুদ্দুস। অবসর জীবনটা গ্রামের বাড়িতে কাটাবেন বলে ঢাকা ছেড়েছিলেন কুদ্দুস। আড়াই বিঘা জমির ওপর ছোট্ট একটা পুকুর আর গাছগাছালিতে ভরা বাড়িতে স্ত্রী, পুত্রবধূ আর নাতিকে নিয়ে থাকেন। ছেলে প্রবাসী।
গত বছর একবার বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। কুদ্দুস বলেন, একসময় এলাকায় জলদস্যুর আতঙ্ক ছিল। এখন সব ডাঙার ডাকাত। আত্মরক্ষা করতে সদর দরজায় লোহার ঝাঁপ লাগিয়েছেন। রাত হলে সেই শাটার ফেলে ঘুমাতে যান দাদা-নাতি।