ট্রেনে ঢিল ছোড়া বন্ধ হবে কবে?

ট্রেনে ছোড়া পাথরে জখম হয়েছে আনোয়ারা বেগমের চোখ। ছবি: সংগৃহীত
ট্রেনে ছোড়া পাথরে জখম হয়েছে আনোয়ারা বেগমের চোখ। ছবি: সংগৃহীত

৬৫ বছর বয়সী আনোয়ারা বেগম ছেলে, মেয়ে ও নাতি নিয়ে ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছিলেন ঈদ করতে। হঠাৎ ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে থেকে একটি ঢিল এসে লাগে আনোয়ারা বেগমের বাঁ চোখের পাশে। এতে তিনি চোখে প্রচণ্ড আঘাত পান। চিৎকার দিয়ে চোখ ধরে বসেন, সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরা তখন পর্যন্ত বুঝতে পারছিলেন না ঘটনাটা কী ঘটল। মুহূর্তেই পরিবারটির ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেল।

২৫ মে আনোয়ারা বেগম ঢাকা থেকে আন্তনগর ট্রেন অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসে করে জামালপুর যাচ্ছিলেন। জামালপুরের মেলান্দহে তাঁর বাড়ি। বেলা দেড়টার দিকে ময়মনসিংহ স্টেশনে ঢুকতে আর কয়েক মিনিট বাকি, ট্রেনের গতি কিছুটা কম, এমন সময়ই দুঃসহ ওই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ট্রেনের কর্মীরা এগিয়ে এসে পানি দেন। আনোয়ারা বেগমের ছেলেমেয়েরা মায়ের চোখ ধরে জামালপুর পর্যন্ত পৌঁছে পরে চিকিৎসকের কাছে যান। ঘটনার সময় আনোয়ারা বেগমের স্বামী আবদুল হাই, ছেলে মনোয়ার হোসেনসহ পরিবারের অনেক সদস্য ছিলেন। ফলে ময়মনসিংহে নামার কোনো উপায় ছিল না বলে জানালেন আনোয়ারা বেগমের ছেলে পোশাক কারখানার কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো পরিবার হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। আনোয়ারা বেগমের আরেক ছেলে ব্যাংকার আবদুল কাদের জিলানী বলছিলেন, ‘ঢাকার রামপুরায় আমার বাসা থেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাবা-মা ঈদ করার জন্য বাড়ি যাচ্ছিলেন। পরিবারের সবাই ছিলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজে। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল। জামালপুরের চিকিৎসক প্রথমে ভেবেছিলেন মা আর চোখে দেখতে পাবেন না। তিনি ঢাকার ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে নিতে বলেন। আমরা দেরি না করে ঢাকা ফিরে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। সোমবার মায়ের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন মায়ের চোখের লেন্স পাল্টাতে হবে, তবে আশার কথা, মা হয়তো আবার পুরোপুরি চোখে দেখতে পারবেন।’

মনোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আম্মাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি, সেই আম্মাকে দেখি চোখ ধরে কাঁদছেন। আম্মার চোখে ঢিল লেগে তা আবার আম্মার পাশে বসা আরেক নারীর গায়ে লাগে। ঘটনার পর আম্মাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জামালপুর রেলওয়ে থানায় মৌখিকভাবে ঘটনার কথা জানানো হয়েছে।’

পাথরের আঘাতে শয্যাশায়ী আনোয়ারা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

বৃহস্পতিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে আবদুল কাদের জিলানী বারবার বলছিলেন, ‘মায়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু এই বয়সেও মা চোখে ভালো দেখতেন। শরীরে কোনো রোগ নেই। সেই মা এখন অসুস্থ। ঈদে বাড়ি যেতে না পারলে মন খারাপ করবেন। তাই সমস্যা হলেও সবাই মিলে বাড়ি গিয়ে ঈদ করব বলে মনঃস্থির করেছি।’

এই ঘটনার সূত্র ধরে টেলিফোনে কথা হয় ময়মনসিংহের আশরাফুর রহমান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বুধবারের এক ঘটনার বিষয়ে জানালেন, ময়মনসিংহ রেল কলোনির কাছেই তাঁর বাসা। একটি ট্রেন যাওয়ার সময় তিনি খেয়াল করলেন, এক লোকের হাতে একটি পাথর। তবে সেই লোকের দিকে খেয়াল রাখার কারণে পাথর হাত থেকে ফেলে দেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর যখন পাথর হাতে রাখার কারণ জানতে চাইলেন, তখন উল্টো সেই লোক বলছেন, পাথর হাতে নিলে সমস্যা কী? তারপর বাগ্‌বিতণ্ডা এবং হাতাহাতি শুরু হলে আশপাশের লোকজন এসে মীমাংসা করে দেন।

জামালপুরের শেরপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাসুমা হোসনি বললেন, ময়মনসিংহ স্টেশনের কাছাকাছি গেলে ট্রেন যখন একটু আস্তে চলে, তখন এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। নিজের পরিবারে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মাসুমা বলেন, সাত থেকে আট বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় তিন মাস বয়সী ভাইয়ের ছেলের চোখ অল্পের জন্য রক্ষা পায়। ওই ঘটনায় ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে ভাইয়ের ছেলেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আরেক মামার মাথায় পাথর লেগে মাথা ফেটে যায়।

মাসুমা হোসনি বলেন, স্টেশনের কাছাকাছি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ঘটনা ঘটছে, তার মানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ঘটনাগুলো সম্পর্কে অবগত আছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। ঢাকা-জামালপুর যাতায়াতে বেশির ভাগ সময় ট্রেনে যাতায়াত করেন তিনি। মাসুমা বলেন, ‘এখন স্টেশনের কাছাকাছি এলেই জানালা নামিয়ে দিই। আর মনের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে। একটি পাথর থেকে কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তা যদি যারা ঢিল ছুড়ছে তারা জানত।’

২০১৩ সালে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক প্রথম আলোতে লিখেছিলেন ‘প্রীতির জন্য ভালোবাসা’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ। প্রীতি দাশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মিন্টু দাশ ঢাকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রধান শাখার কর্মকর্তা ছিলেন। চার ভাইয়ের সংসারে প্রীতি দাশ একমাত্র বোন। খুব জাঁকজমক করে ঘটনার মাত্র ১৭ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল প্রীতি দাশের। তিনি বাবার বাড়িতে গেছেন ঈদের ছুটিতে। চট্টগ্রামে, পশ্চিম পটিয়ার গ্রামে। ট্রেনে করে ফিরছিলেন ঢাকায় ঈদের পরদিন, ১০ আগস্ট ২০১৩। রাতের ট্রেন। ট্রেন সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ভাঙা ব্রিজ এলাকায় গেছে মাত্র। একটু আগে প্রীতি মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন মা-বাবার সঙ্গে, তাঁদের জানিয়েছেন, ‘ট্রেন ছেড়েছে, যাচ্ছি।’ মা বলেছেন, ‘ভালোভাবে যাস।’ সঙ্গে স্বামী। স্বামীর বন্ধু। ট্রেনের জানালার কাচও নামানো। কোনো বিপদ হওয়ার কথা নয়। তবে জানালার কাচ ভেঙে পাথর এসে লেগেছিল প্রীতির মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারান। সীতাকুণ্ড হাসপাতাল, তারপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন প্রীতিকে।

আনিসুল হক লিখেছিলেন, ‘প্রীতির মৃত্যু কি থামাতে পারবে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ছেলেখেলা!’ ২৭ মে ‘চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়বেন না’ শিরোনামে প্রথম আলোতেই আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ট্রেনে চড়ে বাড়ি যাবে হাজারো যাত্রী। তবে এই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে পারে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়ে মারার মতো ঘটনায়। এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করার জন্য সীতাকুণ্ড থানা-পুলিশ সীতাকুণ্ডে চারটি রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকার লোকদের সচেতন করতে ‘চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়বেন না’ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। প্রায় প্রতি ঈদের আগেই এভাবে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়, গণমাধ্যমে তা প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়।

২০১৩ সালে ‘ট্রেনে ঢিল ছুড়ে মারবেন না, আমরা আর কোনো প্রীতিকে হারাতে চাই না’ শীর্ষক স্লোগানে প্রথম আলো চট্টগ্রামের মিরসরাই বন্ধুসভার উদ্যোগে গণসচেতনতামূলক প্রচারণা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ট্রেনে ছোড়া পাথর। ছবি: সংগৃহীত



আবদুল কাদের জিলানী তাঁর মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘একটি ঢিল অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অথচ ঢিল মারা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, একই সঙ্গে এলাকার মানুষকে নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো যায় কি না, তা–ও চিন্তাভাবনা করে দেখতে পারে কর্তৃপক্ষ। আমরা যাত্রীরা তো অসহায়। ওই অবস্থায় নেমে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হয় না।’

ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোশাররফ হোসেন জানালেন, গত বছরের মে মাসে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার একটি মামলার আসামি ধরা পড়েছে। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এমন ঘটনায় বেশির ভাগই অভিযোগ করেন না। 

ট্রেনে ঢিল বা পাথর ছোড়া ঠেকাতে রেলওয়ের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। ঢিল বা পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে রেলওয়ে আইনের ২৭ ধারায় মামলা করার সুযোগ আছে বলে জানান মোশাররফ হোসেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ট্রেনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিশোরেরা ঢিল মারে। রেলওয়ে আইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের অপরাধে মা–বাবাকে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।