গ্রেপ্তার হওয়া ১৩ জনের মধ্যে তিনজন জামিনে মুক্ত। তাঁরা হলেন ময়নুল হক, লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও শফিকুল আলম।
টাকা পাচারের তথ্য পেলেও তদন্ত এখনো শেষ হচ্ছে না
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটকে গ্রেপ্তারের প্রায় ১১ মাস পর তাঁর বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এজাহারে বলা হয়, ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে ওই টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন তিনি। কিন্তু মামলা করার ৯ মাস পরও সিআইডি তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
সম্রাট, বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম, অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধানসহ মোট ১১ জনকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। এ অভিযান আওয়ামী লীগের ভেতরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিতি পায়। দলীয় প্রভাবে ঢাকার ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো–বাণিজ্য করে অল্প সময়ে কয়েকজন নেতার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন সামনে আসে।
ওই সময় পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু এবং রুপন ভূঁইয়ার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দুই দফা অভিযান চালিয়ে নগদ প্রায় ৩২ কোটি টাকা, ৯ কেজি সোনা ও পাঁচ কোটি ১৫ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। অভিযানের সময় অবশ্য দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাঁরা ধরা পড়েন গত বছরের জানুয়ারি মাসে। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের (অর্থ পাচার) অভিযোগে দুজনের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করে সিআইডি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সিআইডির তদন্তে দুই ভাইয়ের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১২৮টি ফ্ল্যাট, ৬৬ কাঠা জমি ও ব্যাংকে ১৯ কোটি ১১ লাখ টাকা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিংয়ের দুই মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি সিআইডি।
দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছিল ৯টি। এর মধ্যে সাতটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিং মামলাসহ দুই মামলার তদন্ত এখনো চলছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সম্রাট, এনু ও রুপন ছাড়া আরও গ্রেপ্তার হন বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম, যুবলীগ নেতা (এখন বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ, চলচ্চিত্রের প্রযোজক এনামুল হক ওরফে আরমান, অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধান, মোহামেডান ক্লাবের লোকমান হোসেন ভূঁইয়া (তখন ডিরেক্টর ইনচার্জ ছিলেন), হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান (তখন ঢাকা উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন), ময়নুল হক ওরফে মনজু (তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন), তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব (তখন ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর) কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের কর্মকর্তা ও কৃষক লীগের নেতা কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ এবং যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত কাজী আনিসুর রহমান।
ইসমাইল চৌধুরী ওরফে সম্রাট :সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। অসুস্থতার কথা বলে এখন হাসপাতালে।
এই ১৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও দুদক পৃথকভাবে মোট ৫৭টি মামলা করে। এর মধ্যে অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা এবং মানি লন্ডারিং আইনে ৩৪টি মামলা করে পুলিশ ও র্যাব। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ময়নুল হক ছাড়া বাকি ১২ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করে দুদক। এই ৫৭ মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত তদন্ত শেষ হয়েছে ৪২টির। বাকি ১৫টি মামলার তদন্ত শেষ না করতে পারার কারণ হিসেবে ‘করোনার সংক্রমণকে’ দায়ী করছেন পুলিশ ও দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা। দুদক যে ২৩টি মামলা করেছে, তার মধ্যে ১১টির তদন্তই এখনো শেষ হয়নি।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আরিফ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ, এনু ও রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলাসহ এ পর্যন্ত ১২ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ১১ মামলার তদন্ত এখনো চলছে।
সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মাদক আইনে একটি, দুই ভাই এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি এবং খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে চারটি মামলা করেছিল র্যাব। এসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এ ছাড়া ময়নুল হকের বিরুদ্ধে করা চাঁদাবাজির মামলা এবং লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে করা মাদক আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি।
র্যাব ও ডিবি সূত্র জানায়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে হওয়া ৫৭টি মামলার মধ্যে ১৮টির তদন্তের দায়িত্ব পৃথকভাবে পেয়েছিল তারা। এসব মামলায় তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে সিআইডির কাছে ছিল ১৬টি মামলা। তারা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে ১২টির।
সিআইডির তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে সম্রাট, খালেদ, এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে করা পৃথক চার মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে। সম্রাটের পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত বছরের ২৫ অক্টোবর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠির জবাব না পাওয়ায় মামলার অভিযোগপত্র আটকে আছে। আর এনু ও রুপনের বিরুদ্ধে হওয়া মানি লন্ডারিং আইনের মামলা তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনের মামলার তদন্তে বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একত্র করতে হয়। তাই এ মামলার তদন্ত শেষ করা একটু জটিল। তবু ইতিমধ্যে ১২ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আরও দুটি মামলার অভিযোগপত্র প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই আদালতে বাকি মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
গ্রেপ্তারের পর অসুস্থতার কথা বলে বেশির ভাগ সময় কারাগারের বদলে হাসপাতালেই রয়েছেন সম্রাট ও জি কে শামীম। দুই মাসের বেশি সময় ধরে দুজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. মাহাবুবুল ইসলাম।
বিএসএমএমইউ সূত্র জানায়, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যার কথা বলে সম্রাট আর জি কে শামীম ডান হাতের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতালে আসার পর শামীম করোনায় আক্রান্ত হলেও এখন তিনি সুস্থ আছেন বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার জানান।
জি কে শামীম ২৯৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক।
রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার দখল করে সম্রাট মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকার চাঁদাবাজি ও সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর তাঁকে ও আরমানকে ফেনীর কাছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের একটি গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই দিন দুপুরে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অভিযান চালান। সেখানে ক্যাঙারুর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাট ও আরমানকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সম্রাটের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছিল চারটি। এর মধ্যে মানি লন্ডারিং মামলা ছাড়া অন্য তিন মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনের জি কে শামীমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র্যাব। ওই অভিযানে তাঁর কার্যালয় থেকে নগদ দুই কোটি টাকা, প্রায় পৌনে ২০০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর), অবৈধ অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করা হয়। শামীম সব সময় সাতজন সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জি কে শামীম বলেছেন, গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, আওয়ামী লীগের কয়েকজন সাংসদ ও যুবলীগের তৎকালীন শীর্ষ নেতৃত্বকে তিনি নিয়মিত চাঁদা দিতেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন সরকারি ভবনের নির্মাণকাজ করছিল। গ্রেপ্তারের পর জি কে শামীমের সঙ্গে করা বেশির ভাগ নির্মাণ চুক্তি বাতিল করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
জি কে শামীম ও তাঁর মা আয়েশা আক্তারের বিরুদ্ধে ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। শামীমের বিরুদ্ধে মাদক, মানি লন্ডারিং ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোট মামলা হয়েছিল তিনটি। সব কটি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা হয়েছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ নেতা খালেদকে। তিনি ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে প্রথমে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। সেদিন রাতে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এনামুল হক এনু রুপন ভূঁইয়া দুই ভাইয়ের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১২৮টি ফ্ল্যাট, ৬৬ কাঠা জমি। মামলা হয়েছে ৯টি।
রিমান্ডে খালেদ র্যাব ও সিআইডি কর্মকর্তাদের বলেছেন, ইয়ংমেনস ক্লাবসহ মতিঝিলে চারটি ক্লাবে ক্যাসিনো চালানোর পাশাপাশি সরকারি সাতটি প্রতিষ্ঠানে¤টেন্ডারবাজি করতেন তিনি। এর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোন রয়েছে। শাহজাহানপুর কলোনি মাঠ, মেরাদিয়া ও কমলাপুর কোরবানির হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
খালেদের বিরুদ্ধে করা সাত মামলার মধ্যে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে আট কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে তদন্ত করছে সিআইডি।
এদিকে ক্যাসিনো–কাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৩ জনের মধ্যে তিনজন এখন জামিনে মুক্ত আছেন। তাঁরা হলেন ময়নুল হক, লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও শফিকুল আলম।
আলোচিত মামলাগুলোর তদন্ত কেন দ্রুত শেষ করা যায়নি, তা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন তদন্ত শেষ হলো না, সে বিষয়ে আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে আশা রাখি। দুই বছর কম সময় নয়।’