একটি মামলা পাল্টে দিল সব

মুদ্রা পাচারের ওই মামলায় অপকর্মে জড়িত সবার নাম আসায় ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাই প্রশ্ন তুলেছেন।

সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল

ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই বরকত ও রুবেলের অপকর্মের দায় খন্দকার মোশাররফ হোসেন এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। জেলা কমিটির পাঁচজন নেতা বলছেন, দুই ভাই খন্দকার মোশাররফের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিল। মূলত তাঁর প্রভাবকে কাজে লাগিয়েই দুই ভাই বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন। বিষয়টি ফরিদপুরের কারও অজানা নয়। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের অভিযোগে করা মামলার অভিযোগপত্রে খন্দকার মোশাররফের নাম কেন আসেনি, সে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গত বুধবার আড়াই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি। এই ১০ জনের সবাই খন্দকার মোশাররফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অভিযোগপত্রে ৩ নম্বর আসামি হয়েছেন খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর। খন্দকার মোশাররফের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) এ এইচ এম ফোয়াদকে ৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে বরকত, রুবেলসহ চারজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। বাকি ছয় আসামি পলাতক।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, ‘চার্জশিটে অনেকের নাম নেই। আমার মনে হয়েছে, এটি পূর্ণাঙ্গ চার্জশিট নয়। তদন্তের পর আরও অনেকের নাম যুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়।’ আর জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ঝর্ণা হাসান এই অভিযোগপত্রকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম আমরা শুনেছিলাম। কেন তাদের নাম এল না, তা বোধগম্য নয়।’

জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ২০১৭ সাল থেকে খন্দকার মোশাররফকে ঘিরে একটি চক্র তৈরি করে বরকত, রুবেল, এপিএস ফোয়াদসহ কয়েকজন। এ চক্রের দৌরাত্ম্য অব্যাহত থাকে গত বছরের জুন পর্যন্ত। সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এলজিইডির ৪৭৫টি ঠিকাদারি কাজ পান বরকত ও রুবেল, যার আর্থিক মূল্য ৮১২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে দুই ভাইয়ের ৯টি ব্যাংকের ১৮৮টি হিসাবে ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। খন্দকার মোশাররফের প্রশ্রয়ে থেকেই চক্রটি ফরিদপুরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে ব্যাপক আকারে তদবির করে তাঁরা এই বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। গত বছরের মে মাসে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলা হয়। ওই হামলার মামলায় গত বছরের ৭ জুন বিশেষ অভিযান শুরু করে পুলিশ। এরপরই ফরিদপুর ছাড়েন খন্দকার মোশাররফের অন্তত অর্ধশত অনুসারী।

এসব বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় আমার ভাইকে (বাবর) কেন যুক্ত করা হলো, তা আমার বোধগম্য নয়। টেন্ডার হয় প্রকল্প পাসের মাধ্যমে। কোনো প্রকল্প প্রণয়নে বাবরের ভূমিকা থাকার কথা নয়। কোনো ঠিকাদারের টাকা বাবর তুলে নিয়েছে, এমন অভিযোগও নেই। আমার মনে হয়, এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, তবে বরকত ও রুবেল ঠিকাদার। প্রকল্প প্রণয়ন ও কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের খবরদারি থাকতে পারে।

‘দলীয় রাজনীতির অবস্থা ভালো ঠেকছে না। সবাই নিজেকে বড় নেতা মনে করে। আমার অনেক বয়স হয়েছে। ৮০-৮২ বছর বয়সে এসে আর কোনো ভেজাল-গুঁতাগুঁতির মধ্যে থাকতে চাই না।’
খন্দকার মোশাররফ

জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সম্পর্কে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘দলীয় রাজনীতির অবস্থা ভালো ঠেকছে না। সবাই নিজেকে বড় নেতা মনে করে। আমার অনেক বয়স হয়েছে। ৮০-৮২ বছর বয়সে এসে আর কোনো ভেজাল-গুঁতাগুঁতির মধ্যে থাকতে চাই না।’

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, খন্দকার মোশাররফ এবং তাঁকে ঘিরে থাকা এই চক্রের সময়কালে জেলা আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতা-কর্মীদের যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তা বিরোধী দলের আমলেও কখনো হয়নি। নেতারা বলছেন, সিআইডির অভিযোগপত্রে মোশাররফ ঘনিষ্ঠ আরও অনেকের নাম আসেনি।

এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক না রেখেই জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপুল ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার্জশিট দেখে হতাশ হয়েছি। কেননা, ফরিদপুরে যা কিছু হয়েছে, তার কিছুই মোশাররফ ও তাঁর ভাই বাবরের কথার বাইরে হয়নি। মোশাররফের নাম নেই অথচ তাঁর ভাই বাবরের নাম আছে, এ যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা।’