করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে আজ বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সাবেক সদস্য ও আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। অথচ এই সাহেদ একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। চেক জালিয়াতির একটি মামলায় ১০ বছর আগে ২০১০ সালে তাঁর ছয় মাসের সাজা হয়। তাঁকে ৫৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ।
ওই আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুস সাত্তার দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেক প্রতারণার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাহেদ করিম। ২০০৮ সালে চেক জালিয়াতির অভিযোগে মজিবর রহমান নামের একজন ব্যবসায়ী সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় বিচার শেষে ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত সাহেদকে ৫৩ লাখ টাকা জরিমানা করেন। একই সঙ্গে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন। আদালত থেকে সাহেদের বিরুদ্ধে তখনই সাজার পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু পুলিশ আজ পর্যন্ত সাহেদকে ধরেনি। ফলে বাদী তাঁর টাকাও পাননি। ওই মামলায় সাহেদ পলাতক ছিলেন। পলাতক থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছিল।’
১০ বছর আগে সাহেদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা কার্যকর না হওয়ায় নতুন করে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত পুনরায় সাজার পরোয়ানা জারি করেছেন। গত সোমবার সাহেদের বিরুদ্ধে সাজার পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
ঢাকার মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. জাফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদ একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত সাজার পরোয়ানা জারি করেছেন। সেই পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালত থেকে দুটি পরোয়ানা আমরা হাতে পেয়েছি। আর সাহেদের বিরুদ্ধে সাজার পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে উত্তরা পূর্ব থানায়।’
করোনা পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট দেওয়াসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ করিমকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে ৭ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করে র্যাব। সেই মামলায় সাহেদকে বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন আট আসামি।
সাজা পরোয়ানা কার্যকর প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতের সাজা পরোয়ানা হাতে পেয়েছি। এ ব্যাপারে এখন আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সাহেদের বিরুদ্ধে উপসচিবের মামলা
প্রতারণার অভিযোগে বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশনে নিয়মিত টক শো করা সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে দুই বছর আগে (২০১৮ সালের ৭ মার্চ) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মাহাবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেডের মালিক সাহেদ স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্মারক ব্যবহার করে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন একটি জাতীয় পত্রিকায়। ডিজিটাল হোল্ডিং অ্যাসেসমেন্ট ও কর আদায় এবং ডিজিটাল নম্বর প্লেট স্থাপন প্রকল্পে সব জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের কর সংগ্রহের জন্য জনবল নিয়োগের আহ্বান করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জারি করা পত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী সাহেদের প্রতিষ্ঠান কোনো অনুমতি নেয়নি। প্রতারণার মাধ্যমে পত্রিকায় জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা ও ১০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফট করার জন্য বলা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের কোনো অনুমতি না নিয়ে সম্পূর্ণ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের পত্রের স্মারক উল্লেখ করে সাহেদের রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড অপরাধ করেছে।
সাহেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, সাজা কম
ঢাকার সিএমএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্যে ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৭টি মামলার প্রমাণ মিলেছে। প্রতিটিই প্রতারণার মামলা। এর মধ্যে উত্তরা পূর্ব থানায় সব থেকে বেশি মামলা হয়েছে। উত্তরা পূর্ব থানায় সাহেদের বিরুদ্ধে আটটি মামলা হয়েছে। আর উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা হয়েছে তিনটি। এ ছাড়া গুলশান থানায় একটি, বাড্ডা থানায় একটি, শাহজাহানপুর থানায় একটি, আদাবর থানায় একটি এবং লালবাগ থানায় আরও একটি মামলা করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সাহেদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়েছে।
ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, উত্তরা পূর্ব থানার ছয়টি মামলায় সাহেদ খালাস পেয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের ডিসি জাফর হোসেন জানান, সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে কতগুলো মামলা বিচারাধীন, সেটি বের করা হচ্ছে। সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় যত মামলা হয়েছে, সেই তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। আবার সাহেদের বিরুদ্ধে আদালতে যতগুলো নালিশি মামলা (সিআর) হয়েছে, সেই তালিকাও খুঁজে বের করা হচ্ছে। ফলে সাহেদের বিরুদ্ধে কতগুলো মামলা আছে, সেটি এখনো চূড়ান্ত করে বলার সময় আসেনি।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০টির অধিক মামলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগরের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদ যে এত বড় প্রতারক, তা আমি জানতাম না। সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরের আদালতে এতগুলো প্রতারণার মামলা, সেই তথ্য পুলিশ কিংবা তাঁর পিপিরা এত দিন জানাননি। কতগুলো মামলায় সাহেদ খালাস পেয়েছেন, সেই তথ্য আমি জানি না। তবে একটি আদালত থেকে সাহেদ ৫টি মামলায় খালাস পেয়ে থাকেন, সেই তথ্য ওই আদালতে দায়িত্ব পালনকারী পিপি আমাকে জানাতে পারতেন।’
পিপি আবদুল্লাহ আবু জানান, এখন থেকে সাহেদের প্রতিটি মামলার তথ্য নেওয়া হবে। তাঁর যাতে সাজা হয়, সেই বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর থাকবে।
সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও ১০ বছর ধরে সাহেদের ধরা না পড়া এবং বেশির ভাগ মামলায় খালাস হওয়া প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, ব্রিটিশ আমলে ১০০ মামলায় চার্জশিট হলে ৯০ ভাগ মামলায় আসামির সাজা হতো। আর এখন হয়ে গেছে উল্টো। বর্তমানে মামলার ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ আসামি খালাস পেয়েছেন। প্রসিকিউশন বিভাগকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে।’