চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবন নির্মাণের ৭৫ কোটি টাকার কাজ জাল কাগজপত্র দাখিল করে হাতিয়ে নেন কথিত যুবলীগ নেতা জি কে শামীম। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জাল কাগজপত্রের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা অনুষদ ভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণকাজের জন্য ২০১৬ সালে ৭৫ কোটি টাকা দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ করে দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। কাজটি পায় জি কে শামীমের মালিকানাধীন মেসার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স—জিকেবিএল (জেভি)। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রভাবে অন্য ঠিকাদারেরা দরপত্র জমা দিতে পারেননি। এর জের ধরে ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর নিজের বাসায় খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী।
অভিযোগ রয়েছে, জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম খানকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়।
প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম খান তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ৭৫ কোটি টাকার দরপত্র উন্মুক্ত করার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী সাপ্তাহিক বন্ধের দিন এ-সংক্রান্ত সভা ডাকার কথা তাঁকে জানিয়েছিলেন। তিনি খোলার দিন সভা ডাকার অনুরোধ করেন। পরে অজ্ঞাত কারণে তাঁকে মূল্যায়ন কমিটিতে রাখা হয়নি।
একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দরপত্রে অনিয়ম ও কার্যাদেশ দেওয়া এবং বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে দুদক। এ জন্য প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামের সঙ্গে কথাও বলেছে প্রতিষ্ঠানটি। দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১–এর সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দরপত্রের কাগজপত্রে জালিয়াতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাল কাগজপত্র দাখিল করেছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানের পর মামলা হতে পারে।
জি কে শামীম নিজেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে পরিচয় দিতেন। গত শুক্রবার র্যাব সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি
নির্ধারিত সময়ে কলা অনুষদ ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৬ শতাংশ কাজ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু সাঈদ হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, কাজ শেষ করার নির্ধারিত সময় আগেই শেষ হয়ে গেছে। সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানের তথ্যানুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জাল কাগজপত্রের ব্যাপারে জানতে গতকাল রাতে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও প্রধান প্রকৌশলী আবু সাঈদ হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের হয়ে নির্মাণকাজ তদারক করছেন ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ।
জি কে শামীমের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে আবুল মনসুর জামশেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো তাঁর (শামীম) সম্পর্কে কেউ কিছু বলেননি। আসলে আমরা চাঁদাবাজি করি না। ব্যবসা করে খেতে চাই। আপনারা সহযোগিতা না করলে আমরা কাজ করব কী করে?’
দিয়াজ প্রসঙ্গে
জি কে শামীমকে ‘মাফিয়া চক্রের হোতা’ অভিহিত করে নিহত দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর বড় বোন আইনজীবী জুবাঈদা ছরওয়ার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর গ্রেপ্তারের খবরে স্বস্তি পাচ্ছি। শামীমকে অন্যায়ভাবে এবং মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন ৭৫ কোটি টাকার কাজ দেয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে আমার ভাই দিয়াজ খুন হন।’