প্রায় দুই যুগ আগে সপরিবার চট্টগ্রাম আসেন মিয়ানমারের নাগরিক মো. আবুল কাশেম। নগরের চান্দগাঁও এলাকা থেকে ২০০৯ সালে স্ত্রী জোহরা বেগমসহ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করেন। মাঝে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান কাশেম। ২০১৫ সালে পটিয়ায় ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেন জোহরা। পরের বছর ছেলে মো. তোয়াছের ভোটার হন।
পটিয়ার কচুয়াই এলাকায় জমি কিনে বসবাস শুরু করে পরিবারটি। তাঁদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর জোহরা ও তোয়াছেরকে এক মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন পটিয়াউপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাবিবুল হাসানের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জোহরা এবং তাঁর ছেলের নামে জন্মসনদ দেওয়ার অভিযোগে কচুয়াই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এস এম ইনজামুল হক ও বরলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান শাহীনুর ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বরলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান শাহীনুর ইসলাম বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, একজন রোহিঙ্গা ভুলে জন্মসনদ পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সনদটি বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসন বরাবর আবেদন করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এভাবে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে জন্মসনদ নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভোটার হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তোয়াছের সম্প্রতি জন্মসনদ নিতে গেলে তাঁদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের বিষয়টি ধরা পড়ে। জনপ্রতিনিধিদের সনদ নকল করেও ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করছেন অনেক রোহিঙ্গা। চলমান হালনাগাদ কার্যক্রমে ভোটার হতে গিয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে আটজন রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার হয়েছেন গত ১৮ সেপ্টেম্বর।
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান প্রথম আলোকে বলেন, জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে জন্মসনদ নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা ভোটার হতে আসছেন। আবার কেউ কেউ জনপ্রতিনিধিদের সনদ নকল করেও আবেদন করছেন। এ রকম কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নগরের বন্দর থানায় একটি মামলা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা সাবধান হলে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন মুনীর হোসাইন খান।
জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নগরে এখন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম চলছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সব উপজেলা এবং উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একটি বিশেষ কমিটির ছাড়পত্র নিয়ে ভোটার করা হয়। নগরে এই কমিটি নেই। এই সুযোগে এখানেও রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যে কয়েকজন রোহিঙ্গা ভোটার হতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা সবাই ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর নামে সনদ জাল করেছেন।
রোহিঙ্গার আশ্রয়
২০১৬ সালে তোয়াছেরের পাশাপাশি মো. ইব্রাহিম নামের আরেক রোহিঙ্গাকে জন্মসনদ দেন কচুয়াই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম ইনজামুল হক। পাশাপাশি কচুয়াই এলাকার বাড়িতে রোহিঙ্গাদের এনে রাখা এবং তাদের বাংলাদেশি জন্মসনদ ও এনআইডি পেতে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে জোহরার বিরুদ্ধে।
জানতে চাইলে পটিয়ার ইউএনও হাবিবুল হাসান বলেন, পরিবারটি অনেক আগে পটিয়ায় আসে। তারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছিল। যদি তারা বাংলাদেশি হয় তাহলে এত দিন পরে কেন জন্মসনদ নিতে হলো? এ কারণে চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এস এম ইনজামুল হক বলেন, ‘আগের ভোটার, শিক্ষাসনদ দেখে চারজনকে জন্মসনদ দিয়েছিলাম।’
বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়। জানতে চাইলে পটিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ছৈয়দ আবু সাঈদ বলেন, জোহরা ভোটার হয়েছেন চান্দগাঁও এলাকায়। এরপর ২০১৫ সালে এখানে স্থানান্তর হয়। পরের বছর মায়ের এনআইডি দেখিয়ে তাঁর ছেলে ভোটার হন এখানে। তাঁদের এনআইডি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তিনি আরও বলেন, জনপ্রতিনিধির সনদ নিয়ে এসে অনেকে এনআইডির জন্য আবেদন করছেন। বিশেষ কমিটি ছাড়পত্র দিলে এনআইডি পাচ্ছেন। এ রকম অসম্পূর্ণ শতাধিক আবেদন বাতিল করা হয়। এর মধ্যে রোহিঙ্গাও থাকতে পারে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পটিয়ায় গত এক মাসে ৩২ রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া পটিয়া থেকে দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে বাসযোগে উখিয়ার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নগরে ভোটার হওয়ার চেষ্টায় রোহিঙ্গারা
চট্টগ্রাম নগরে এখন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম চলছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সব উপজেলা এবং উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় বিশেষ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। একটি বিশেষ কমিটির ছাড়পত্র নিয়ে ভোটার করা হয়। নগরে এই কমিটি নেই। এই সুযোগে এখানেও রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করছে।
বন্দর থানা এলাকায় ভোটার হতে গিয়ে আট রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর সই জাল করে নাগরিক সনদ তৈরির অভিযোগ রয়েছে।
বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী বলেন, নাগরিক সনদ জাল করে ওই রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে তাঁদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।