ঘোড়াঘাট থানার ওসিকে ‘দায়িত্বে অবহেলার’ কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অন্যতম সন্দেহভাজন দুই রংমিস্ত্রির রিমান্ড শেষ। দ্বিতীয় দফায় তাঁদের রিমান্ড চায়নি পুলিশ।
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার দুদিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে গ্রেপ্তার হওয়া এক সন্দেহভাজনের বরাত দিয়ে ‘চুরির গল্প’ শুনিয়েছিল র্যাব। এক সপ্তাহের মাথায় পুলিশের তদন্তে ভিন্ন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, চুরি নয়, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন ইউএনও ও তাঁর বাবা। হামলার প্রধান সন্দেহভাজন ইউএনওর কার্যালয়েরই চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী। তাঁর সঙ্গে আরও কেউ কেউ যুক্ত থাকতে পারেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ও উপজেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, প্রায় চার মাস আগে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ব্যাগ থেকে ৫০ হাজার টাকা চুরি হয়। সেই সময় উপজেলা কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে ওই কর্মচারী তখন জিজ্ঞাসাবাদে চুরির কথা স্বীকার করেননি। পরবর্তী সময়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাঁকেই টাকা চুরিতে শনাক্ত করা হয়। শাস্তি হিসেবে ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা এবং সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার প্রায় আট মাস আগে ওই কর্মচারী জেলা প্রশাসকের বাংলোতে ফরাশ পদে কাজ করতেন। সেখানে তাঁর কাজ সন্তোষজনক না হওয়ায় ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়। ওই কর্মচারীর এক ভাই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে জেলা প্রশাসনের একটি অফিসে কর্মরত। পুলিশ তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঘোড়াঘাট ইউএনওর বাসভবনে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যে ব্যক্তিকে দেখা যায়, সেই ব্যক্তির দৈহিক গড়ন ও হাঁটাচলার সঙ্গে সন্দেহভাজন কর্মচারীর অনেক মিল রয়েছে। পুলিশ আরও কয়েকটি দিক থেকে বিষয়টি যাচাই করে দেখছে।
২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে বাথরুমের জানালা দিয়ে ইউএনওর বাসভবনে ঢুকে তাঁকে ও তাঁর বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই বাসভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে পর্যালোচনা করে।
সন্দেহের কেন্দ্রে উপজেলা প্রশাসনেরই চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী। অন্য এক বা একাধিক কর্মচারীও যুক্ত থাকতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চারটি সিসি ক্যামেরার মধ্যে একটি নষ্ট ছিল। বাকি তিনটির ফুটেজে দেখা যায়, হামলার আগে ২ সেপ্টেম্বর রাত একটার দিকে হামলাকারীকে বাসভবনের পশ্চিম প্রান্তের দেয়ালের বাইরে প্রথম দেখা যায়। তিনি হেঁটে এসে ভবনের প্রাচীরসংলগ্ন স্টাফ কোয়ার্টার ভবনের গলিতে ঢোকেন। তাঁর হাতে একটি লম্বা লাঠি ও একটি ব্যাগ দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে দেখা যায় দেয়ালঘেরা ইউএনওর বাসভবনের আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করতে। তখন রাত ১টা ১৮ মিনিট। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা ইউএনওর ভবনের আঙিনায় ওই ব্যক্তিকে হাঁটাচলা করতে দেখা যায়। এই সময়ে তাঁকে ভবনের পশ্চিম প্রান্তে নিচতলার জানালা দিয়ে কয়েকবার উঁকি মারতে দেখা যায়। এরপর দক্ষিণ প্রান্তের কবুতরের খোপ থেকে মই নিয়ে তিনি পশ্চিম প্রান্তের বাথরুমের জানালার কাছে নিয়ে যান। এরপর মই হাতে এদিকে–সেদিক করতে দেখা যায় তাঁকে। একবার বাথরুমের জানালার কাছে মই রাখেন, আবার সরিয়ে নেন। এ রকম তিনবার করতে দেখা যায়। এরপর বাড়ির পূর্ব প্রান্তে গোলঘর থেকে একটি চেয়ার নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পরই আবার সেই চেয়ার গোলঘরে রেখে আসেন। পরে বাসভবনের সামনের বাতি নিভিয়ে দেন।
বাসার পূর্ব প্রান্তে অবস্থানকালে বৈদ্যুতিক বাতির আলোতে সিসি ক্যামেরায় ওই ব্যক্তির পরনে লাল রঙের টি–শার্ট স্পষ্ট বোঝা যায়। আবার অন্য ক্যামেরাগুলোর ফুটেজে তাঁর পোশাক ঠিকমতো বোঝা যায় না, ওই সব ক্যামেরার দিকে আলো কম ছিল। রাত ৩টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ওই ব্যক্তিকে বাসার আঙিনায় দেখা গেছে। এরপর বাড়ির আঙিনায় তাঁর আর কোনো ফুটেজ নেই। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, রাত তিনটার পর হামলাকারী বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। ৪টা ৪০ মিনিটে বাসভবনের পশ্চিমের সীমানাদেয়ালে সেই মইটি রাখতে দেখা যায় তাঁকে। এরপর ভবনের সীমানাদেয়ালের বাইরে স্টাফ কোয়ার্টারের সেই গলিতে (যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলেন) হেঁটে যেতে দেখা যায় তাঁকে। তখনো তাঁর হাতে ব্যাগ ও লম্বা লাঠি ছিল। বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে গিয়ে উপজেলা কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক হয়ে হেঁটে বের হতে দেখা যায় তাঁকে।
মামলার তদন্তের নতুন অগ্রগতি বিষয়ে জানতে প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয় থেকে গত রাতে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ফুটেজে ইউএনওর বাসভবনে নৈশপ্রহরী নাজিম হাসানকে (পলাশ) দেখা যায়। তাঁকে প্রথমে ভবনের পশ্চিমে বাথরুমের জানালার নিচ বরাবর উঁকি দিতে দেখা যায়। পরে তাঁকে ভবনের সদর দরজায় যেতে দেখা যায়। এরপর আবার কবুতরের খোপের দিকে ফিরে আসেন। এসে সীমানাদেয়াল থেকে সেই মই সরিয়ে নিয়ে ভবনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখেন। পরক্ষণেই আবার সেই মই হাতে নিয়ে কবুতরের ঘরে ঠেস দিয়ে রাখেন। কর্মকর্তারা মনে করছেন, মইটি নিয়ে নৈশপ্রহরী নাজিম হাসান অস্বস্তিতে ছিলেন। যার কারণে তাঁকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন।
ফুটেজে দেখা যায়, মই রাখার পর নৈশপ্রহরী নাজিম হাসান ইউএনওর বাসভবনের নিচতলার দরজায় টোকা দেন। এরপর সিঁডি দিয়ে দোতলায় উঠে আবার নেমে যান। তদন্ত–সংশ্লিষ্টদের মতে, এ সময় তাঁকে খুব অস্থির দেখাচ্ছিল। ফোন নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। এর মধ্যেই লোকজন আসা শুরু করেন।
ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নৈশপ্রহরী সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ইউএনও ওয়াহিদার বাবা ওমর আলীর চিৎকার শুনে নৈশপ্রহরী নাজিম দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তালা দেখতে পান। এরপর তিনি মই বেয়ে পশ্চিম পাশের বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে ঢুকে অবস্থা দেখে চিৎকার শুরু করেন।
হামলার ঘটনার দশম দিনে এসে ঘোড়াঘাট থানার ওসি আমিরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে দিনাজপুর পুলিশ লাইনসে যুক্ত করা হয়েছে। রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আজিমউদ্দীনকে ঘোড়াঘাট থানায় পদায়ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দিনাজপুরের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দায়িত্বে অবহেলার কারণে আমিরুল ইসলামকে পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করা হয়েছে।’
এদিকে হামলার ঘটনায় শুরুতে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দুই রংমিস্ত্রি নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাসের সাত দিনের পুলিশি রিমান্ড গতকাল শেষ হয়েছে। গতকাল বিকেলে তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁদের নতুন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেনি পুলিশ। আদালত তাঁদের জেলহাজতে পাঠিয়েছেন।
সন্দেহভাজন হিসেবে ওই দুজনের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন স্থানীয় যুবলীগের নেতা আসাদুল ইসলাম। তাঁর পুলিশ রিমান্ড শেষ হবে আজ শনিবার। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিনজনের কারও কাছ থেকে ঘটনা নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানো যায়, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এই তিনজনকে আটকের পর ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে রংপুরে ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে। র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার আসাদুল ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আসাদুল র্যাবকে জানিয়েছেন, নিছক চুরির অভিপ্রায় থেকে ঘটনাটি ঘটে যায়।
ঘটনার পরপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যুবলীগ নেতাসহ স্থানীয় আরও কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীসহ এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন ইউএনও ওয়াহিদা অবশ হয়ে যাওয়া ডান হাতের আঙুল নাড়াচাড়া করতে পারছেন। তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক মো. জাহেদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াহিদা খানমের ডান দিকটা অবশ। তবে আশার কথা, ওয়াহিদা তাঁর ডান হাতের আঙুল নাড়াচাড়া করতে পারছেন। ফিজিওথেরাপি দিলে অবশ থেকে তাঁর অবস্থা স্বাভাবিক হতে পারে। তাঁকে এখন নরম খাবার খেতে দেওয়া হচ্ছে।