আত্মহত্যার আগে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খানের লিখে যাওয়া চিঠির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও হোটেল কর্ণফুলীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খানকে তিনি চেনেন না। তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়া ও তাঁকে অপমান করার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব খানের আত্মহত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। গতকাল কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের জরুরি সভায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর তোপখানা রোডের হোটেল কর্ণফুলীর একটি কক্ষ থেকে আইয়ুব খানকে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। হোটেলের ওই কক্ষ থেকে একটি চিঠি উদ্ধার করা হয়। এতে লেখা রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান ‘গলাধাক্কা দিয়ে অপমান করে বের করে দেওয়ায় আমি আত্মহত্যা করলাম।’ পুলিশ ধারণা করছে, কীটনাশক পান করে আইয়ুব আত্মহত্যা করেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুবকর সিদ্দিক গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, হোটেল কক্ষ থেকে উদ্ধার হওয়া আইয়ুবের কাগজপত্রের সঙ্গে তাঁর লেখা চিঠির মিল রয়েছে। তারপরও বিষয়টি নিশ্চিত হতে এই চিঠিটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হস্তলিপি বিশারদের কাছে নিরীক্ষা করানো হবে। তিনি বলেন, এই চিঠির বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও হোটেল কর্ণফুলীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ওসি বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে আইয়ুব খানের মামাতো ভাই ব্যবসায়ী আমির হোসেন শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। তাঁর ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের জব্দ করা ওই চিঠিতে লেখা রয়েছে, ‘মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট ঘোষণার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নানকে দুবার মাছ, শুঁটকি ও টাকা দিয়েছি। ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর বাসায় যাই। ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে অপমান করে বের করে দেওয়ায় হোটেল কর্ণফুলীতে আমি আত্মহত্যা করলাম।’
চার পৃষ্ঠার এই চিঠিতে আইয়ুব খান একই বক্তব্য কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করেন। প্রতিটি পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিটের নামে সিল ও সদস্যসচিবের স্থলে তাঁর সই রয়েছে। চিঠির দুটি অংশে ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের বরাবরে আইয়ুব খান লেখেন, ‘তার লাশটা যেন ঢাকায় দাফন করা হয়।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সকালে আইয়ুব খানের লাশ তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মরফলায় নেওয়া হয়। জানাজা শেষে পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সচিবকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন মামলার বাদী আইয়ুবের মামাতো ভাই আমির হোসেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নিজের ও ধারদেনা করা টাকা তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট ঘোষণার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে খরচ করেছেন। এ কারণে তিনি আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিলেন। সংসারের হাল ধরতে তাঁর বড় ছেলে আরিফ হোসেন একটি দোকানের কর্মচারীর চাকরি নেন। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।
জানতে চাইলে গতকাল রাতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হেলাল মোর্শেদ খান দাবি করেন, এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ইউনিট গঠনে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। এ জন্য আইয়ুব খান সচিবের কাছে আসা-যাওয়া করতেন। কমিটি গঠন নিয়ে তিনি টাকাও খরচ করেছেন। কিন্তু কমিটি গঠন না হওয়ায় একপর্যায়ে তিনি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল বিভিন্ন ইউনিট গঠন করে।
গতকাল প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘অপমান করে বের করে দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যা?’ শীর্ষক খবরের প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল সকালে একটি লিখিত বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান। তিনি বলেন, পত্রিকায় কমিটি গঠন, অর্থ নেওয়া ও অপমান করার বিষয়ে যা বলা হয়েছে সে বিষয়ে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চট্টগ্রাম (দক্ষিণ) ইউনিট কমান্ডের আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে যে বিষয়টি বলা হয়েছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই এই কাজে সচিবের বাসায় যাওয়া কোনো মতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।