সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের বিষয়ে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দপ্তর এক সংবাদ সম্মেলন করে। তাতে জানানো হয়, ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টায় সম্পৃক্ততার দায়ে দুই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সৈয়দ জিয়াউল হক পালিয়ে গেছেন। সংবাদ সম্মেলনে এটুকুই জানানো হয় তখন। আর তাঁকে ধরিয়ে দিতে ছবিসহ সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।
এর চার বছর পর মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের হত্যায় সৈয়দ জিয়াউল হক জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৬ সালে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়, সৈয়দ জিয়াউল হক আল–কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান। এই জঙ্গি সংগঠন ২০১৩ সাল থেকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে গেছে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জিয়ার নাম শুনেছিলেন তাঁরা, তবে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৩ সালে আনসার আল ইসলামের তাত্ত্বিক গুরু জসীম উদ্দীন রাহমানী গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেন, রাজধানীর বছিলায় যে মসজিদের তিনি খতিব ছিলেন, সে মসজিদে যাতায়াত ছিল জিয়াউল হকের। যোগাযোগ ছিল ই–মেইলেও। এরও প্রায় তিন বছর পর ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাড্ডার সাতারকুলে একটি অভিযানের পর পুলিশ সংগঠনটির কাঠামো সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। তারা জানতে পারে, এই সংগঠনের সামরিক প্রধান জিয়াউল হক।
বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়সহ ছয়জন মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার খুনের বিচার শেষে আবারও আলোচনায় এসেছেন সৈয়দ জিয়াউল হক। ছয়টি খুনের ঘটনাতেই তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। প্রশ্ন উঠছে, তিনি কোথায়? কেন ধরা পড়ছেন না!
সিটিটিসির উপকমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সৈয়দ জিয়াউল হক কোথা থেকে কোথায় গেছেন, তার একটা চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেয়েছে। কমপক্ষে চারবার তাঁর খুব কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছিল পুলিশ। জিয়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহে ছিলেন। এমনকি ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকায় আসার টিকিট কাটতে গিয়েছিলেন তিনি। টিকিট না পেয়ে স্টেশনেই হট্টগোল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘অসৎ লোকজন কালোবাজারি করছে, টিকিট থাকার পরও বিক্রি করছে না।’ তাঁকে ঘিরে সে সময় ভিড় জমে যায়। ওই ব্যক্তিই যে সৈয়দ জিয়াউল হক, সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয় পরে। তা ছাড়া বাড্ডার সাতারকুলে তিনি দীর্ঘ সময় ছিলেন।
এ ছাড়া অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সায়মনের ময়মনসিংহের বাসায় কয়েক মাস থেকেছেন জিয়া। টঙ্গীতে গিয়েছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। তল্লাশি অভিযান শুরুর আগেই সটকে পড়েন। এমনকি ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খুব কাছাকাছি এসেও কৌশলে পালিয়ে যান তিনি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আনসার আল ইসলামের সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পর থেকে জিয়া দলের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। করলেও ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন।
তবে সৈয়দ জিয়াউল হককে ছোটবেলা থেকে দেখেছেন এমন এক ব্যক্তি গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউল হককে ধরতে তাঁর থেকে অন্তত দুই ধাপ এগিয়ে থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাঁর ভাষায়, জিয়া শৈশবে অনেকের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। সেনানিবাস থেকে পালানোর সময় ২০১২ সালের ১০ জুন সৈয়দ জিয়াউল হক সিলেট ক্যাডেট কলেজ, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ৪১তম লং কোর্স এবং মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) গ্রুপে মেইল করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিয়ার এই সহপাঠীও (যিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন) মেইলটি পান।
জিয়ার ওই সহপাঠী প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াকে তিনি চেনেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় থেকে। তাঁর বাবা সৈয়দ জিল্লুল হক পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে সৌদি আরবে থাকতেন। জিয়া ক্যাডেট কলেজে ভর্তির আগেই ছয় থেকে সাতবার ওমরাহ করেছেন। কলেজে ছুটির সময় জিয়া সৌদি আরবে বাবা–মায়ের কাছে চলে যেতেন। তাঁর মতে, জিয়াকে তাঁদের কিছুটা ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ও মনে হতো। জিয়া পড়তেন কম, কিন্তু এসএসসিতে মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ছিলেন সিলেট ক্যাডেট কলেজের সেরা অ্যাথলেট। মাসে ২০০ টাকার কুপন দিয়ে ক্যানটিন থেকে ইচ্ছেমতো খাবার কিনে খাওয়া যেত, সবাই কোক ও চিপস খেলেও জিয়া খেতেন না। বন্ধুদের কুপন দিয়ে দিতেন। খুব জনপ্রিয় ছিলেন ছাত্রদের মধ্যে। তবু কলেজ কর্তৃপক্ষের খটকা ছিল।
সেটা কেমন? জানতে চাইলে জিয়ার ওই সহপাঠী বলেন, ক্যাডেটরা দুপুরে খাবার খাওয়ার পর থেকে বিকেলে খেলতে যাওয়ার আগপর্যন্ত বিশ্রামের একটা সময় পায়। সন্ধ্যায় যার যার ধর্মমতে প্রার্থনা করার বাধ্যবাধকতা থাকে। জিয়া শাহজালাল হাউসে থাকতেন। তিনি যখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র, তখন জোহরের নামাজ জামাতে পড়ার চল শুরু করেন। প্রথম নামাজে ইমামতি করলেও পরে তিনি তালিম দিতে শুরু করেন।
কলেজ কর্তৃপক্ষের বিষয়টি ভালো লাগেনি। তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে তাঁর অনুসারীরা তো বটেই, সাধারণ ছাত্ররাও খেপে যায়। কারণ, তিনি কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিতেন না। বাগ্মী ছিলেন, ছাত্ররা তাঁর কথায় আকৃষ্ট হতেন। কোনোভাবেই জিয়াকে আটকাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হাউস অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রিফেক্ট করা হয়।
যদিও কলেজের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে তিনি গেমস প্রিফেক্ট হবেন—এমনটাই ধারণা ছিল সবার। এ সময়ও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির জন্য তাঁকে সতর্ক করা হয়। অ্যাসিস্ট্যান্ট হাউস প্রিফেক্ট পদ থেকে সরানোর আলোচনাও ওঠে। এবারও তাঁর সহপাঠীরা বেঁকে বসেন। সৈয়দ জিয়াউল হক সম্মানের সঙ্গেই ১৯৯৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছাড়েন। যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। সেখানেও সোর্ড অব অনার পান। তখনো তাঁর ওপর নজরদারি ছিল। জিয়া পাত্তা দিতেন না।
জিয়ার ওই সহপাঠী বলেন, এর মধ্যেই ২০০৮ সালের দিকে জিয়া তাঁদের বন্ধু এক সংস্কৃতিকর্মীকে সাংস্কৃতিক চর্চা বন্ধ করতে বলেন। বন্ধুটি তাঁকে বলেন, ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্বাস একেকজনের একেক রকম। এসব নিয়ে তিনি কথা বলতে চান না।
বাল্যবন্ধু হলেও জিয়া তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। ২০০৯ সালে এসে তাঁর বন্ধুরা টের পান, জিয়ার মধ্যে গোঁড়ামি চরমে পৌঁছেছে। ওই বছর তাঁরা সবাই জিয়ার স্ত্রীর মৃত্যুর পর জানাজায় অংশ নেন। বনানী কবরস্থানে দাফনের আগে তিনি একটি বক্তৃতা দেন। অনেকেই চমকে ওঠেন ওই দিন এবং তাঁকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ৪০ দিন পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেখানে দুটি সন্তান আছে জিয়ার। তবে বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। জিয়াও আগে যেমন হুটহাট মেইল করতেন তাঁদের, তা–ও বন্ধ বহু বছর।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, তাঁরা নতুন করে জিয়াকে গ্রেপ্তারে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকে ধরতে পুলিশের সর্বাত্মক অভিযান চলছে। জানা গেছে, গত মঙ্গলবার পুলিশ ঢাকায় তাঁর শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও জিয়ার শ্বশুর তাঁদের জানিয়েছেন, জিয়ার ছেলে তাঁর কাছে থাকলেও তিনি (জিয়া) ছেলের খোঁজখবর করেন না। আদালতের মাধ্যমে তিনি ছেলের অভিভাবকত্ব নিয়েছেন। পুলিশ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে।