স্বজনদের মুক্তিযোদ্ধা বানানো, ঘুষ নেওয়া ও প্রতিষ্ঠানের দলিল অন্যের কাছে বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব অভিযোগ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অন্তত দুই সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জামুকা গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানের কাজে কোনো সমন্বয় নেই, নেই জবাবদিহি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নিয়োগবিধি ছাড়াই জামুকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিয়োগবিধি নেই বলে জামুকার কর্মকর্তারা কোনো অন্যায় করলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। জামুকা থেকে নিয়োগবিধি করার জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর এগোয়নি।
জামুকার সহকারী পরিচালক শাহ আলম দুই বছর আগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর বাবা মো. মোসলেহ উদ্দিন এবং শ্বশুর বজলে কাদিরকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাইয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তাঁদের সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর তা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এই কারণে শাহ আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর দুই বছর চলে গেছে, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন শাহ আলমের বাবার নামে আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা গেজেট পাওয়া গেছে। এ জন্য গত ১৪ মে জামুকার ৬২তম বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
শুধু ভুয়া গেজেট নয়, জামুকার ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, এই পরিচালক গেজেট বাতিলের হুমকি দিয়ে সোহেল তারিপ নামের একজনকে আজিমপুর এতিমখানা মোড়ে দেখা করতে বলেন এবং পাঁচ লাখ টাকা চান। টাকা না দিলে তাঁর বাবা লুৎফর রহমান লিটনের গেজেট বাতিল করে দেওয়া হবে হুমকি দেন। সোহেল প্রমাণসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। এ ছাড়া শাহ আলম বরগুনার তালতলীর বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা দীপ্তি রানী পালকে ফোন করে বলেন, তাঁর বিষয়ে প্রতিবেদন জামুকায় এসেছে, তিনি যেন ৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দীপ্তি রানী বিষয়টি জামুকার মহাপরিচালককে জানান। তবে শাহ আলম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছিলেন, তাঁর কাছে তালতলী থেকে কোনো প্রতিবেদন আসেনি। পরে শাহ আলমের কক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি পাওয়া যায়।
জামুকার কর্মকর্তারা জানান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে ওই বৈঠকে শাহ আলমও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শাহ আলমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে জামুকার ডিজিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সম্প্রতি জামুকা কার্যালয়ে শাহ আলমের কক্ষে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিজেকে অত্যন্ত সৎ দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার অনেক টাকা আছে। আমি কেন ঘুষ চাইব? এসব ষড়যন্ত্র।’
গভীর রাতে অফিস করেন হাফিজুর
জামুকার আরেক সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ওই বৈঠকে আটটি অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, তিনি বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে তা ফেরত দেন না। তিনি প্রায়ই রাতে অফিস করেন এবং অফিসের বিভিন্ন মূল নথি ও নথির ফটোকপি নিজের হেফাজতে রাখেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, মুক্তিযোদ্ধা মাল্টিপারপাস ফাউন্ডেশন পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও তিনি পরিদর্শন না করেই প্রতিবেদন দিয়েছেন। রূপনগরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির ব্যাপারে অভিযোগ ছিল, তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। দুই বছর পার হলেও তিনি তা দেননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামুকায় কেউ কোনো কাজ করে না। তাই সারা রাত অফিসে থেকে আমাকে কাজ করতে হয়। আমার কাছে অনেক কিছুর ফটোকপি আছে। এগুলো আমি আমার দরকারে রাখি।’
সিদ্ধান্তহীনতা
জামুকার বৈঠকে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা বাস্তবায়িত হয় না। একবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়, আবার পরে বহাল করা হয়। গত ২১ মার্চ জামুকার ৬১তম সভায় ৬০ জন সরকারি কর্মচারীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়। ওই সভায় জামুকার সদস্য সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে বলেছিলেন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে অনেকের নাম নেই, তবু কেন সনদ বাতিল করা হলো?
ওই সময় জামুকার সদস্যরা বলেন, ভুলবশত তাঁরা ১৫ জনের সনদ বাতিল করেছিলেন। তাঁদের নাম গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ছিল না। জামুকার মহাপরিচালক সভায় এই ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে তাঁদের গেজেট পুনর্বিবেচনা করে সনদ ও গেজেট বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
জামুকায় আবদুল খালেক নামের একজন সহকারী পরিচালক আছেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ক্যাশিয়ার ছিলেন। অথচ জামুকায় তিনি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা (সহকারী পরিচালক) হিসেবে কাজ করছেন। জামুকার নিয়োগে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তাঁরা যে অপরাধ করেছেন, সে জন্য তদন্তের পর তাঁদের বরখাস্ত করা হবে। এত বড় অন্যায়ের জন্য ফৌজদারি মামলা হবে।
অবশ্য এমন কথা মন্ত্রী আগেও কয়েকবার বলেছেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামুকার বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই আমরা নানা ধরনের অভিযোগ শুনে আসছি। বিশেষ করে আর্থিক লেনদেনের। মুক্তিযোদ্ধা হোক আর অমুক্তিযোদ্ধা, সকলের কাছ থেকেই কিছু কর্মকর্তা নানাভাবে অর্থ নিচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়টি দেখা উচিত।’