ধর্ষণ মামলার আসামির গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আর লাশের সঙ্গে চিরকুটে ধর্ষকের স্বীকারোক্তি বা সম্ভাব্য ধর্ষকদের পরিণতি সম্পর্কে সাবধানবাণী লেখা থাকছে। চিরকুটে ধর্ষকের হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে গ্রিক দেবতা হারকিউলিসের ওপর। ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ, সাধারণ মানুষ ধর্ষকের লাশ উদ্ধারে একধরনের স্বস্তি প্রকাশ করলেও নারী, মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষকের অভিযোগ আছে এমন ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গুলি করে মেরে ফেলা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত শুক্রবার ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার আন্ডারিয়া গ্রামে পরিত্যক্ত ইটভাটার পাশে রাকিব মোল্লার (২০) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য, রাকিব পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার এক মাদ্রাসাছাত্রী (১৩) ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি। রাকিবের লাশের গলায় সুতা দিয়ে ঝোলানো সাদা কাগজের চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি পিরোজপুর ভান্ডারিয়ার... (অমুকের) ধর্ষক রাকিব। ধর্ষকের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকেরা সাবধান-হারকিউলিস।’
এর আগে ২৬ জানুয়ারি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলা থেকে সজল জমাদ্দার (৩০) নামের এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সজলের লাশের সঙ্গে থাকা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার নাম সজল। আমি ... (অমুকের) ধর্ষক। ইহাই আমার পরিণতি।’ এই দুজন একই মামলার আসামি।
এ ছাড়া গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকার আশুলিয়ায় এক কিশোরী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি রিপনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রিপনের লাশের সঙ্গে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি রিপন, গত ৫ জানুয়ারি আশুলিয়ার...নামে মেয়েকে ধর্ষণ করেছি।’ রিপনের পরিবারের দাবি, একদল লোক গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে রিপনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
চলতি বছরে এ পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ আছে এ ধরনের চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। শুধু একজনের বেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘ক্রসফায়ার’ বলে স্বীকার করেছে। তবে চিরকুটসহ লাশের বেলায় এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়নি বা কেউ দায় স্বীকার করেনি। উল্টো নিহত সজল জমাদ্দারের বাবা কাঠালিয়া থানায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন। তাতে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবাসহ অন্যদের হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। অন্যদিকে, নিহত রাকিবের বাবার সন্দেহ, তাঁর ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছেন। ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর রাকিব ঢাকা চলে আসেন এবং পরে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পর তাঁর মা আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে পুলিশ জিডি নেয়নি বলেও অভিযোগ করেছে পরিবারটি।
ধর্ষণের অভিযোগ থাকা ব্যক্তিদের চিরকুটসহ পরপর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে, তারা কেউ হত্যার দায় স্বীকার করে না। অনেক সময় দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ বা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে দেশে আইনের শাসন থাকার তো আর দরকার নেই। এই সব পথে গিয়ে কোনো দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ফিরে আসেনি, বাংলাদেশেও আসবে না। ২০০৪ সালের দিকে ক্রসফায়ারের ঘটনার শুরুর দিকে অনেক এলাকায় মিষ্টি পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছিল। তবে ক্রসফায়ারের পর দেশে অপরাধ কমে গেছে বলে কেউ দাবি করতে পারছে না। ধর্ষকদের ভয় দেখাতে হলে ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ১৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১১টি মামলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটনে এখন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তবে ধর্ষণ মামলার আসামিদের গুলিবিদ্ধ লাশ এবং চিরকুট পাওয়ার বিষয়টি একটি রহস্য তৈরি করেছে। বিষয়টিতে খটকা লাগছে। ধর্ষণের অভিযোগ থাকলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় নিতে হবে। এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। ধর্ষণ মামলার আসামিও যদি পুলিশের কাছে আসে, সেই আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও পুলিশের কাজ।
প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরে (২০০২-১৬) আসা ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধান করেছিল। দেখা যায়, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিরকুটসহ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এ ধরনের ঘটনা মেনে নিতে পারি না। ধর্ষককে ভয় দেখাতে হলে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমরা চাই ধর্ষকের শাস্তি, আর তা আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রেখেই হতে হবে। আর ধর্ষকেরা চিরকুটে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে হঠাৎ এত মহানুভবতা দেখানো শুরু করল কেন, তাও বোধগম্য নয়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ধর্ষণ জঘন্যতম অপরাধ। তবে তা আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। বলা হয়, কেউ যাতে নিজের হাতে আইন তুলে না নেয়। অথচ এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তাই করা হচ্ছে। কোনো মানুষ বা গোষ্ঠী অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দিতে পারে না। এতে আইনের শাসন থাকছে না।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। পুলিশ ইচ্ছে করলেই বের করতে পারে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কারা ঘটাচ্ছে। আইনের আওতায় ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।