ঢাকা থেকে বেলারুশ

খেলোয়াড় সাজিয়ে মানব পাচার

কারাতে প্রতিযোগিতার নামে আট তরুণকে বেলারুশে পাচার করেন বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের সহসভাপতি নাজমুল মোরশেদ।

অপরাধ
প্রতীকী ছবি

‘কিওকুসিংকান কারাতে’ বাংলাদেশে সেভাবে প্রচলিত নয়। এই কারাতের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ‘গোমেল কাপ’ গত বছর অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশে। সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করেছিলেন বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের সহসভাপতি নাজমুল মোরশেদ। ওই আমন্ত্রণপত্রের বিপরীতে খেলোয়াড় সাজিয়ে তিনি আটজন তরুণকে ইউরোপে পাচার করেন বলে অভিযোগ। প্রত্যেক তরুণের কাছ থেকে বেলারুশে যাওয়ার জন্য চার লাখ করে আর বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত তিন লাখ টাকা করে নেওয়ার চুক্তি হয়।

প্রবাসের স্বপ্নে বিভোর ওই তরুণেরা জানতেনও না সামনে কী অপেক্ষা করছে। পাচার হওয়া চারজন কোনোরকমে দেশে ফিরেছেন। বাকিদের খোঁজ নেই।

মানব পাচারের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর নাজমুল ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁরা মানব পাচারের অভিযোগ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই জবানবন্দিতে পাচারের এসব গল্প উঠে এসেছে।

মানব পাচারের অভিযোগে গত ২৫ নভেম্বর নাজমুল ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁরা মানব পাচারের অভিযোগ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৫ নভেম্বর নাজমুল মোরশেদকে মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁর অপর দুই সহযোগী হাসান আলী ও ওমর ফারুকও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পাচার হয়ে যাওয়া আট তরুণের চারজন দেশে ফিরে এসেছেন। বাকিরা কোথায় জানা যায়নি।

আগে খেলাধুলার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বিদেশে পৌঁছানোর পর কেউ কেউ শিবির ছেড়ে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে। তবে সেসব ঘটনায় সংগঠকেরা আড়ালেই থেকে গেছেন। লিবিয়ার মিজদাহতে চলতি বছরের মে মাসে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার পর মানব পাচার নিয়ে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৪৪৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ৮৪৮ জনকে।

লিবিয়ার মিজদাহতে চলতি বছরের মে মাসে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার পর মানব পাচার নিয়ে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মামলা

নাজমুল মোরশেদ ও তাঁর দুই সহযোগী হাসান আলী ও ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় গত বছরের ১ ডিসেম্বর মামলা করেন মোজাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া। এ মামলার ১ নম্বর সাক্ষী আবদুর রহিম। মোজাম্মেল হোসেনের ভাগনে সাজ্জাদ হোসেন ও আবদুর রহিমের ভাইপো মো. আমজাদ হোসেন ও আত্মীয় মীর হোসেন মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের সহসভাপতি নাজমুল মোরশেদের খপ্পরে পড়েছিলেন।

মামলার এজাহারে মোজাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া অভিযোগ করেন, বছরখানেক আগে নাজমুলের সহযোগী হাসান আলী তাঁর অফিসে এসেছিলেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই আসতেন। হঠাৎ একদিন হাসান আলী বলেন, তাঁদের কাছে বেলারুশ হয়ে পোল্যান্ডে লোক পাঠানোর সুযোগ আছে। মোজাম্মেল বিষয়টি তাঁর বন্ধু আবদুর রহমানকে জানান। তারপর দুজন মিলে স্বজনদের বেলারুশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তিতে (তিনজনের) বেলারুশে পৌঁছাতে ১২ লাখ টাকা এবং সেখান থেকে পোল্যান্ডে পৌঁছানোর পর আরও সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিতে সম্মত হয়েছিলেন বিদেশ যেতে ইচ্ছুক তরুণেরা। কথা ছিল বেলারুশে তিন মাসের ভিসা করিয়ে দেবেন তাঁরা।

আদম ব্যাপারীদের মিষ্টি কথায় পটে গেছিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। কোনোরকমে প্রাণ হাতে ঢাকায় ফিরছি।
মীর হোসেন, ভুক্তভোগী

নাজমুলকে ঢুকতে দেয়নি বেলারুশ

সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, নাজমুল মোরশেদ ভুক্তভোগীদের জাতীয় ক্রীড়া উন্নয়ন পরিষদে নিয়ে মাসখানেকের মতো প্রশিক্ষণ দেন। এরপর দল নিয়ে যান ভারতে ভিসা করাতে। ভিসা পেয়ে তরুণদের নিয়ে তাঁরা বেলারুশে যান গত বছরের ১৮ অক্টোবর। সেখানকার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর নাজমুল মোরশেদকে বেলারুশে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানায় সেখানকার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। বাকি তরুণদের চার দিনের জন্য ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় করা মামলার এজাহারে বলা হয়, একপর্যায়ে বেলারুশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন আমজাদ হোসেন ও মীর হোসেন। সাজ্জাদ হোসেনের ঠাঁই হয় সেখানকার এক আশ্রয়শিবিরে।

নাজমুল মোরশেদ ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে মানব পাচার করছেন, এ কথা জানতেন ভুক্তভোগীরা। তারপরও কেন এভাবে ইউরোপে যেতে চাইলেন, জানতে চাইলে ফেনীর ছেলে মীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু স্বপ্নপূরণেই পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বেলারুশ হয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা দুই বোন, এক ভাই। বাবা কুয়েতে থাকেন। এক বোনের স্বামী ইতালিতে থাকেন। আশপাশের অনেকে বিদেশে আছেন। তিনি নিজে ঢাকা কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন। তবু চাকরিবাকরি করতে ইচ্ছা হয়নি।

মীর হোসেন জানিয়েছেন, তিনি আর ইউরোপে যেতে চান না। তিনি বলেন, মীর হোসেন বলেন, ‘আদম ব্যাপারীদের মিষ্টি কথায় পটে গেছিলাম। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। কোনোরকমে প্রাণ হাতে ঢাকায় ফিরছি।'

মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৪৪৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ৮৪৮ জনকে।
মো. সোহেল রানা, পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক

আবারও সহসভাপতি নাজমুল

বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান মণির সঙ্গে কথা হয় ১৯ ডিসেম্বর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় নাজমুল মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন না। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতেই তিনি আবারও ফেডারেশনের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। পাচারে জড়িত কি না, তা–ও জানেন না।