ধর্ষণের শিকার ৭৬ নারী

কয়েকজন ‘ভয়ংকর’ চালকের কারণে শঙ্কিত চট্টগ্রামের নারীরা

বায়েজিদে ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার চালক ও সহকারী
 ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন যানবাহনের কিছু চালক। একই জায়গায় চার দফা ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে শহরে চলাফেরা করতে গিয়ে কিছু বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিং গাড়ির চালক ও চালকের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬ জন নারী। সর্বশেষ গত ১৯ জুন দুপুরে নগরের ব্যস্ততম অক্সিজেন মোড়ে এক গৃহবধূকে বাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় চালক, তাঁর সহকারীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগের মাসে ১৯ মে পোশাককর্মীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণচেষ্টার আরেক মামলায় চালক ও তাঁর সহকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ঘটনার শিকার বেশির ভাগই গৃহবধূ ও কারখানার শ্রমিক। এভাবে কিছু যানবাহনের চালকেরা ভয়ংকর হয়ে ওঠায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নারীরা।

ধর্ষণের ঘটনা বাড়ায় নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা নগরে নারীদের জন্য পৃথক বাস চালুর দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক নগরে ২৫ লাখ নারীর জন্য আলাদা বাস নেই। এ কারণে বাস, অটোরিকশাসহ সব ধরনের পরিবহনচালক, সহকারীদের ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। বিভিন্ন সভায় বারবার বলা হলেও প্রশাসন কিংবা গাড়িমালিক, চালকদের সংগঠন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসব অপরাধ বাড়ছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে নগরে ধর্ষণের মামলা হয় ১০৮টি, ২০১৮ সালে ১৩০, ২০১৯ সালে ১৯৫ এবং ২০২০ সালে ২২৭, ২০২১ সালে ২৪৮, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৪২টি। এসব মামলার মধ্যে ৭৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন গাড়িচালক ও সহকারীদের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে বহদ্দারহাটে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রথম সবার নজরে আসে।

ধর্ষণের ঘটনায় ব্যবহৃত বাসটি জব্দ করে পুলিশ

একই জায়গায় চার দফা ধর্ষণ

নগরের ব্যস্ততম অক্সিজেন মোড়। এখান থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, রাউজান, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী যাওয়া বাসগুলো ছাড়ে। স্থায়ী বাস টার্মিনাল না থাকায় সড়কের আশপাশে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়িগুলো। ভেতরে থাকেন চালকসহ তাঁদের সহকারীরা।

নগরের ডবলমুরিং এলাকার এক গৃহবধূ মারধরের শিকারের ঘটনায় মামলার করতে তাঁর এক আত্মীয়ের কাছে যান পরামর্শের জন্য বায়েজিদ বোস্তামী ছিন্নমূল এলাকায়। ১৯ জুন দুপুরে আত্মীয়ের বাসা থেকে আদালতে মামলা করতে যেতে অক্সিজেন মোড়ে আসেন তিনি। তখনই তাঁকে কোতোয়ালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসে তুলে নেন এক চালক। কিন্তু বাসে কোনো যাত্রী ছিলেন না। পরে দরজা বন্ধ করে ওই গৃহবধূকে চালক ও তাঁর সহকারী ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ চালকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

ঠিক একই জায়গায় দুই বছর আগে ২০২০ সালের ৭ জুন এক পোশাককর্মী (২৩) বাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। সেদিন গাড়িতে ওঠার জন্য আসেন নগরের অক্সিজেন মোড়ে ওই পোশাককর্মী। কিন্তু তুমুল বৃষ্টির কারণে বাসে ওঠা হয়নি তাঁর। রাস্তার পাশে একটি বন্ধ দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ান বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। তখনই নজর পড়ে বাসচালকের। দোকানটির পাশে পার্ক করে রাখা একটি বাসে জোরপূর্বক ওই তরুণীকে তুলে নেন তাঁরা। পরে র‍্যাব মো. ইসমাইল (৩২) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে।

এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ওই বছরের ২৯ আগস্ট অক্সিজেন মোড় এলাকায় স্বামীর সামনে থেকে এক নারীকে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় ওই নারীর স্বামীর করা মামলায় পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। আসামিদের সবাই অক্সিজেন শহীদনগর এলাকার বাসিন্দা অটোরিকশাচালক।

একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর অক্সিজেন মোড়ে চান্দগাঁও এলাকার বাসায় যাওয়ার জন্য দাঁড়ান এক পোশাকশ্রমিক। একটি সিএনজিতে ওঠার পর তাঁকে পার্শ্ববর্তী কলোনিতে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনায় ওই পোশাককর্মী বাদী হয়ে সিএনজিচালক আবির হোসেনের নামে মামলা করেন।

ধর্ষণের চারটি ঘটনার মধ্যে তিনটি বিচারাধীন। একটি তদন্তাধীন। ধর্ষণের শিকার এক পোশাককর্মী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দিনদুপুরে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে বাসে তোলার সাহস আসামিরা কীভাবে পান? তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে মেয়েরা নিরাপদে চলতে পারবেন না।

টাঙানো নেই নম্বরপ্লেট ও চালকের ছবি

চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা রোধে ২০১৯ সালের জুন মাসে নগরের বাস, অটোরিকশা, হিউম্যান হলারের (ছোট বাস) ভেতর চালক ও তাঁর সহকারীর ছবি, লাইসেন্স ও গাড়ির নম্বর টাঙানোর নির্দেশ দেয় পুলিশ। এরপর কিছু গাড়িতে তা লাগানো হয়, যাতে গাড়ির ভেতর কোনো ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী গাড়ির নম্বর ও চালকের নাম পুলিশকে জানাতে পারেন। সম্প্রতি সরেজমিনে নগরের মুরাদপুর, অক্সিজেন মোড়, ২ নম্বর গেট, কোতোয়ালি মোড়ে দেখা যায় বাস, অটোরিকশার ভেতর চালকের ছবিসহ কিছুই টাঙানো নেই। কোতোয়ালি মোড় এলাকায় বাসচালক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি কখনো শুনিনি এগুলো টাঙাতে হবে।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালিকেরা তাঁদের কখনো বলেননি।

বাকলিয়ায় চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার চালক ও সহকারী

বন্ধ হয়ে আছে আলাদা বাস সার্ভিস

সাড়ে পাঁচ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে নগরের বহদ্দারহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত আলাদা বাস সার্ভিসটিও। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রয়াত সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরে নারী ও শিশুদের যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘবে ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল ১০টি বাস ভাড়া নিয়ে এ সেবা চালু করেন। পরে করপোরেশনের তহবিল থেকে ২০০৬ ও ২০০৯ সালে দুই দফায় ১৯টি বাস কেনা হয়। প্রথমে কেবল নারী ও শিশুদের জন্য চালু করা হলেও, পরে এই সেবা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকা, ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০১৬ সালের শেষের দিকে বাস সার্ভিসটি বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন।

বাস সার্ভিসটি চালু করা হবে কি না, প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করা হবে। এখনই বলা যাচ্ছে না কিছু।

ঝুলে আছে ৮১২ মামলা

চট্টগ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সাতটি। ধর্ষণের ঘটনায় হওয়া ৮১২টি মামলা এখানে বিচারাধীন। এর মধ্যে গাড়িচালকের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনার মামলাও রয়েছে। ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর নগরের বহদ্দারহাটে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণের ঘটনা প্রথম সবার নজরে আসে। ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল ডবলমুরিং থানা এলাকার মোগলটুলীর বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী। পরে উবারের চালক মো. বাদশাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেন, ঘটনার আগের দিন গাড়ির ভেতরে ওই কিশোরীকে দুই দফা ধর্ষণ করেন। দ্বিতীয়বার ধর্ষণের সময় অজ্ঞান হয়ে যায় কিশোরী। পরে বাসায় ফিরে লজ্জায় কিশোরী আত্মহত্যা করে। দুটি মামলা এখনো বিচারাধীন। মামলার বাদী কিশোরীর বোন প্রথম আলোকে বলেন, বিচার যেন পান, সেই আশায় আছেন তাঁরা।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা রয়েছে। সাক্ষী হাজির না হওয়াসহ নানা কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।

গাড়িমালিক ও শ্রমিকনেতাদের ভাষ্য

দোষী চালকদের বিচার চান গাড়িমালিক ও শ্রমিকনেতারা। চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম বলেন, অনৈতিক কোনো কাজে না জড়াতে চালকদের বিভিন্ন সভায় সতর্ক করা হয়। অভিন্ন মন্তব্য করলেন চট্টগ্রাম সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. হারুন। তিনি বলেন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির মতো অপরাধী চালক হলেও বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।

পুলিশ কমিশনার যা বললেন

বাস, অটোরিকশায় নারী ধর্ষণ, চালকেরা ধর্ষণে জড়িয়ে পড়াসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ঘটনায় জড়িত চালক ও সহকারীদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি দু-একজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এসব ঘটনা রোধে চালক ও মালিকদের সচেতন করতে যা যা করণীয়, সব করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নগরের সব সিএনজি–অটোরিকশাকে অ্যাপসের আওতায় আনা হয়েছে। শুধু গাড়ির নম্বর দিয়ে চালক, মালিককে মুহূর্তের মধ্যে শনাক্ত করা যাচ্ছে। বাকি যানবাহনগুলো পর্যায়ক্রমে অ্যাপসের আওতায় আনা হবে। গাড়ির ভেতর চালকের ছবিসহ গাড়ির নম্বর টাঙানো জোরদার করা হচ্ছে। ঘটনা রোধে বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নজরদারি।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি গাড়িতে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসানোর কথা থাকলেও, তা হয়নি। বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন ও গাড়ির মালিক, শ্রমিক সংগঠনগুলো চালক ও সহকারীদের যেভাবে সতর্ক করা উচিত, সেভাবে করা হচ্ছে না। ধর্ষণসহ পৈশাচিক এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। রাস্তায়, যানবাহনে নারীরা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, সে পরিবেশ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। যানবাহনে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সুরক্ষা আইন করতে হবে। নাহলে এসব ঘটনা বাড়তে থাকবে।