জুয়া খেলতে অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর সুযোগ করে দিয়ে মোহামেডান ক্লাব থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পেত পুলিশ। ক্লাবের দৈনিক আয়–ব্যয়ের হিসাবপত্রে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই হিসাবপত্রে ‘বিজনেস প্রমোশন’ (ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার জন্য উন্নয়ন ব্যয়) নামে একটি খাত রয়েছে। এই খাতে খরচ হতো প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা, যা পুলিশসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা পেতেন বলে ক্লাবের কয়েকজন কর্মচারী ও দুজন জুয়াড়ি জানিয়েছেন।
প্রথম আলোর হাতে আসা মোহামেডান ক্লাবের দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্রেও (গত জানুয়ারি মাসের সাত দিনের) এই তথ্য পাওয়া গেছে। ক্লাবটির দৈনিক ব্যয়ের হিসাবপত্রেও পুলিশের জন্য টাকা বরাদ্দের আলাদা ঘর রয়েছে। তবে পুলিশের কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বা কোন থানাকে এই টাকা দেওয়া হতো, তা হিসাবপত্রে উল্লেখ নেই। অবশ্য ছালাউদ্দিন ও সজল নামের দুই ব্যক্তির নাম পুলিশের জন্য বরাদ্দ রাখা টাকার ঘরের (নথিতে) পাশে লেখা রয়েছে। তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।
মোহামেডান ক্লাবের দৈনিক আয়–ব্যয়ের হিসাবপত্রে পুলিশের জন্য টাকা বরাদ্দের ঘর থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাব থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা টাকা নিতেন—এমন কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
এর আগে গত শনিবার মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওমর ফারুক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ক্লাবে ক্যাসিনো চলার তথ্য তিনি জানতেন না। টাকা নেওয়ারও প্রশ্নই আসে না। যদিও গত বছরের ১০ জুলাই তিনি মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি বরাবর চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, ‘মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো নামক খেলা পরিচালিত হচ্ছে। ক্যাসিনো নামক খেলা পরিচালনা করার জন্য যে সকল বৈধ কাগজপত্র আছে, তা তদন্তের প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে থানায় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।’
গত রোববার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবে তল্লাশি চালিয়ে ক্যাসিনো বোর্ডসহ বিপুল পরিমাণ জুয়া খেলার সামগ্রী উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে গত বুধবার গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ও ওয়ান্ডারার্স এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবের জুয়ার আসরে অভিযান চালায় র্যাব। এর মধ্যে বনানীর ক্লাবটিতে ক্যাসিনো বোর্ড না থাকলেও ছিল জুয়ার সামগ্রী।
মোহামেডান ক্লাবের দৈনিক আয়–ব্যয়ের হিসাবপত্র অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি ক্লাবের আয় ছিল ৫১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সেদিন ব্যয় হয় ৩৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সবাইকে ‘ভাগ’ দিয়ে তাদের লাভ হয় ১৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। ভাগের একটি অংশ ‘মিডিয়া’কে দেওয়া হয়। সেই টাকার পরিমাণ সেদিন ছিল ৮ হাজার ৫০০ টাকা। কর্মচারীরা বলছেন, ‘মিডিয়া’ আসলে কয়েকজন সাংবাদিক।
ক্লাবের দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্র অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি ‘বিজনেস প্রমোশন’ (এক্সট্রা বা অতিরিক্ত) খাতে টাকার অঙ্কের ঘরে লেখা আছে ৮১ হাজার টাকা। এর পাশে লেখা ‘পুলিশ’।
মোহামেডান ছাড়া মতিঝিলের পাঁচটি ক্লাবে (আরামবাগ, ভিক্টোরিয়া, দিলকুশা, ওয়ান্ডারার্স ও ইয়ংমেনস) প্রতিদিন ক্যাসিনো থেকে গড়ে ৫০ লাখ টাকা করে বাণিজ্য হতো। এর মধ্যে গড়ে প্রতিটি ক্লাবের লাভ হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এসব ক্লাবের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে টাকার অঙ্ক সম্পর্কে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। প্রতি ক্লাব থেকে পুলিশসহ প্রভাবশালীরা নিতেন গড়ে ৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোহামেডানসহ ছয়টি ক্লাব থেকে প্রতিদিন পুলিশসহ প্রভাবশালীরা পেতেন ৩০ লাখ টাকা।
গত বুধবার র্যাব ইয়ংমেনস ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালানোর পর দিলকুশা, আরামবাগ, ভিক্টোরিয়া ও মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিজেরাই ক্লাবে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ক্লাবের সামনে বসানো হয় পুলিশি পাহারা। কিন্তু গত শনিবার সন্ধ্যার পর দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাব থেকে কম্পিউটার ও ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার হার্ডডিস্ক সরিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রোববার এই চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে জানান, শনিবার সন্ধ্যার পর পুলিশের সামনেই ক্লাবের তালা খুলে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে যান ক্লাবের কর্মচারীরা।
এ ব্যাপারে মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শিবলী নোমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্লাবগুলোতে কোনো কম্পিউটার কিংবা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার হার্ডডিস্ক পাওয়া যায়নি। যা জব্দ করা হয়েছে তা আদালতকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করে ক্লাবের জায়গায় ক্যাসিনো ব্যবসার জন্য ১৪ মাস আগে ভাড়া দিতে বাধ্য হন বলে দাবি করেন মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক সারওয়ার হোসেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তি মোহামেডান ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন। ক্লাবের সঙ্গে ক্যাসিনো ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই বলে তিনি দাবি করেন। তবে তিনি বলেন, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতার নির্দেশে ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন কাশেম।
ক্লাবের কর্মচারীদের তথ্য অনুযায়ী, কাশেম ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। থাকেন শান্তিনগরে। তিনি নিজেকে মোহামেডান ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বলে বিভিন্ন জায়গায় পরিচয় দেন। এই পরিচয় দিয়েই তিনি ক্লাবের নতুন ভবনের (যেখানে ক্যাসিনো খেলা হতো) জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ নিয়েছেন। তিনিই সাতজন নেপালিকে দিয়ে ক্লাবে প্রথম ক্যাসিনো বোর্ড চালু করেন।
সার্বিক বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাসিনো চালাতে যে লেনদেন হতো, এটি আসলে ঘুষ। পুরো বিষয়টি নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।