কুষ্টিয়ায় জাতীয় শোক দিবসের র্যালি শেষে দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম সবুজ হোসেন (২৪)। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সকালে জেলা আওয়ামী লীগ শহরে র্যালি বের করে। এতে সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শহরের মজমপুর রেলগেট এলাকার উত্তর দিকে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে র্যালিটি শেষ হয়। এরপর নেতা-কর্মীরা যে যাঁর মতো আশপাশেই অবস্থান নেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যুরালের একটু দূরে রেলগেটের দক্ষিণ দিকে দুটি মিছিল মুখোমুখি হয়। একটি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের, অন্যটি শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমানের সমর্থকদের। দলীয় আধিপত্য নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিরোধ চলছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মোমিনুর এ সময় রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। মিছিল দুটি মুখোমুখি হওয়ামাত্রই সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষ ও ছুরিকাঘাতে সবুজসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে প্রথম আলোর প্রতিনিধিও ছিলেন। তাঁর সংগৃহীত এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সংঘর্ষ চলাকালে কালো পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক গুলি চালাচ্ছেন। ভিডিওতে তাঁর চেহারা স্পষ্ট। এ সময় তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়। ঘটনাস্থলের ৩০-৩৫ ফুট দূরেই কুষ্টিয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পুলিশের একটি দল অবস্থান করছিল। গুলির ঘটনার পরপরই পুলিশ ওই যুবককে ধাওয়া করলে মিছিল দুটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ওই যুবকও পালিয়ে যান।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা তাপস কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে সবুজ হোসেন মারা যান। তাঁর বুকের বাঁ পাশে ধারালো অস্ত্রের দুটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আহত অন্যদের মধ্যে একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া শহরতলির ঢাকা ঝালুপাড়া গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে সবুজ হোসেন আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। বিকেলে লাশ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ: সবুজের চাচাতো ভাই বকুল হোসেনের ভাষ্য, সবুজ দলের কোনো পদে ছিলেন না। মোমিনুর রহমানের হয়ে মিছিলে গিয়েছিলেন। যোগাযোগ করা হলে মোমিনুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবুজ নিরীহ ছেলে ছিল। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে।’ তিনি বলেন, গুলির ঘটনার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘মোমিনুর নিজের লোকদের হত্যা করে আমাদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ মিছিলে অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, যারা এটা করেছে, তারা আমাদের পক্ষের ও মতের লোক না।’
সবুজের বাড়িতে আহাজারি: সবুজরা চার ভাই। তাঁর বাবা মোবারক হোসেন কুষ্টিয়া সুগার মিলে কাজ করেন। সবুজ বহিষ্কৃত নেতা মোমিনুর রহমানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তাঁর লাশ বিকেলে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবুজের মা রেহানা বানু বলেন, ‘আমার সোনামণিকে এনে দাও, জাদুমণিকে এনে দাও। ও তো কোনো রাজনীতি বোঝে না। শোক র্যা লিতে যাওয়ার কথা বলে চলে গেল। র্যা লি শেষে এসেই খাবার খাবে, আর এল লাশ হয়ে।’
বাবা মোবারক হোসেন বলেন, ‘গ্রাম্য রাজনীতির শিকার হয়েছে সবুজ। এলাকার লোকজন এ ঘটনায় জড়িত আছে। লাশ দাফনের পর থানায় হত্যা মামলা দেওয়া হবে।’
পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অস্ত্রটি কার, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা দুই পক্ষের হয়ে তদবির করেছেন। সবকিছু বিবেচনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।