টিফিনে বা ছুটির ঘণ্টা পড়লেই স্কুলের পাশের দোকানগুলোয় মন ছুটে যায়। সাধারণত ভ্রাম্যমাণ এসব দোকান। সেখানে ঝালমুড়ি, ফুচকা, ভেলপুরি বা বাহারি আচার থরে থরে সাজানো। বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক নয়—এমন সাবধানবাণী মা-বাবা বা অন্য অভিভাবক বরাবরই শোনান। তবে ফুচকাওয়ালার দুই চাকার ঠেলা স্টলটিতে ফুলে থাকা ঠাসা ফুচকাগুলো দেখলে মন কি মানে! তাই নিষেধের বাণী তখন মন থেকে হাওয়া।
স্কুলের জন্য দেওয়া বরাদ্দ অর্থ দিয়ে নিজেই শুধু নয়, কখনো কখনো মা-বাবার উপস্থিতিতেই এসব খাবার গোগ্রাসে খাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। ছেলেমেয়েদের পীড়াপীড়িতে অভিভাবক বেচারাদের যেন কিছুই করার নেই।
তবে নিশ্চিন্তে যারা বাইরের এসব মুখরোচক খাবার গলাধঃকরণ করছে প্রতিদিন, তাদের জন্য খারাপ খবর আছে। এ খবর দিয়েছে খাবারের মান পরীক্ষায় রাষ্ট্রের একমাত্র রেফারেন্স প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল)। এক বছর ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার ৪৬টি স্কুলের সামনে থেকে তারা ঝালমুড়ি, ফুচকা, ভেলপুরি ও আচারের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোয় কৃত্রিম রং, ইস্ট, ই-কোলাই, কলিফর্ম, মাইকোটক্সিন, সালমোলিনার মতো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সব উপাদান পেয়েছে।
খাবারের নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ভয়াবহ শঙ্কার কারণ আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি বলেন, যেসব জীবাণু এসব খাদ্যদ্রব্যে পাওয়া গেছে, তাতে খুব সহজেই শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে। আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-কোলাই ভয়ানক জীবাণু। এখানে আমাশয়ের মতো অসুখের বাইরে মূত্রপথের মারাত্মক সংক্রমণ হতে পারে। সালমোনিলা টাইফয়েডের জীবাণু। মাইকোটক্সিনের কারণে হতে পারে চরম ডায়রিয়া। পচা গম, পচা চালে ফাঙাস জন্মে। এটাই মাইকোটক্সিন। নষ্ট হয়ে যাওয়া মুড়ি থেকে বা পচা ময়দার ভেলপুরি বা ফুচকার পুরি থেকে এটা তৈরি হতে পারে।
এ গবেষণার সঙ্গে থাকা এক গবেষক বলেন, ‘ঢাকার ৫০টির মধ্যে ৪৬টি থানার প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি এমন প্রতিষ্ঠানের কাছের দোকানগুলো থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহরের নামী স্কুল-কলেজ আছে। সব জায়গার খাবারের মান অত্যন্ত নিম্ন।’
গবেষণার জন্য ৪৬টি ঝালমুড়ি, ৩০টি ফুচকা, ১৬টি ভেলপুরি ও ৪২টি আচারের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৪৬ ঝালমুড়ির সব কটিতেই মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম এবং ৩টিতে সালমোনিলা পাওয়া যায়। ৩০ ফুচকার সব কটিতে মেলে কলিফর্ম, ইস্ট মোল্ড, ২৭টিতে ই-কোলাই, সব ভেলপুরিতে ই-কোলাই পাওয়া যায়। তবে আচারের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো।
এনএফএসএলের প্রধান অধ্যাপক শাহনীলা ফেরদৌসী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছরের মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে এসব নমুনা সংগ্রহ করে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয় এনএফএসএলের নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে।’
এনএফএসএলের খাদ্য গবেষণার এই ফলাফল নিয়ে কথা বলা হয় রাজধানীর মনিপুরীপাড়ার মনিরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী নাজনীন আক্তারের সঙ্গে। এ দম্পতির একমাত্র ছেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি নামী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মনিরুল বলেন, ‘বাচ্চার অনুরোধে আমিই ওকে খাইয়েছি। সব সময় মনে হয়েছে এটা করা ঠিক হচ্ছে না। তারপর সবার দেখাদেখি ছেলে জেদ ধরেছে।’
মনিরুলের স্ত্রী নাজনীন স্কুলের আশপাশে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানগুলো থাকার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এদের সামান্য লাভের জন্য আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে।’
একাধিক অভিভাবক খাদ্য পরীক্ষার এই ফলাফল জানার পর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি, স্কুল কর্তৃপক্ষ, সরকারি প্রশাসন, এমনকি সিটি করপোরেশনকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায় কতটুকু? প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, ‘স্কুলের আশপাশে এসব দোকানির উৎপাত চলছেই। আমরা উঠিয়ে দিলে দূরে গিয়ে বসে। আবার কিছুদিন পর চলে আসে।’ তিনি বলেন, ফুড পয়জনিং শিক্ষার্থীদের প্রায়ই হয়। আবার টাইফয়েডও আছে। খাদ্য পরীক্ষার এই ফলাফল খুবই উদ্বেগজন। তবে এসব নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সহযোগিতা চাই। তারা বা প্রশাসন ছাড়া এগুলো রোধ করা যাবে না।’
স্কুলের পাশের খাদ্যদ্রব্যগুলোর পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহর কাছে। ফলাফল দেখে তিনি বলেন, ‘এটা ভয়াবহ ব্যাপার। প্রাথমিক অবস্থায় পেটের পীড়া নৈমিত্তিক ঘটনা হবে। তবে এসব জীবাণু যদি রক্তে মেশে, তবে শিশুদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেবে। এসব শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে।’
অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রতিরোধই প্রধান অস্ত্র। এর প্রাথমিক প্রতিরোধ আসতে হবে মা-বাবা বা অভিভাবকদের কাছে থেকে। তাঁদের কর্তব্য হলো সন্তানদের বোঝানো। তিনি এসব খাবার যাঁরা তারা তৈরি করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন।
আরও যেসব খাদ্যদ্রব্য: এনএফএসএল স্কুলের পাশের খাবারের বাইরে নুডলস, ঘি, সরিষার তেল, সয়াবিন, সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, ফুলকপি, বেগুন, শিম, কাঁচা মরিচের ৪১০ ধরনের নমুনা পরীক্ষা করে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাইরে কুমিল্লা, রাজশাহী, ফরিদপুর, পাবনা ও যশোর থেকে এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ১৫টি লাচ্ছা ও সাধারণ সেমাই পরীক্ষায় একটি সেমাইয়ে এবং ১০টি লাচ্ছা সেমাইয়ে মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্দ্রতা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫৫টি নুডলসের মধ্যে ১৩টিতে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণ প্রোটিন মেলে। তবে কোথাও নুডলসে সিসার ক্ষতিকর মাত্রা পাওয়া যায়নি। নমুনায় নেওয়া ৩০টি ফুলকপির মধ্যে ১২টিতে ক্লোরোপাইরিফস–জাতীয় কীটনাশক, কাঁচা মরিচের ৩০টির মধ্যে ১৫টিতে ক্লোরোপাইরিফস পাওয়া যায়।