জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট বিভাগে দুর্নীতির ১৯টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৬ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট নিয়ে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দলের সুপারিশে এসব কথা উঠে এসেছে।
দুদক সূত্র জানায়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন সংস্থার জন্য দুদকের আলাদা আলাদা দল রয়েছে। কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের দুর্নীতি পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে সংস্থার পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি আছে। কমিটি সম্প্রতি ওই বিভাগের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা ও তা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করেছে। কমিশন তা সম্প্রতি অনুমোদনও করেছে।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি কমিশনের পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব সারোয়ার মাহমুদের স্বাক্ষরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবরে পাঠানো হয়েছে।
দুদক সূত্র বলছে, কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক দল বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের (অংশীজন) সঙ্গে আলোচনা, কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাটসংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনা, সরেজমিনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন, গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যাদি এবং কমিশনের গোয়েন্দা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে ওই প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য কমিশনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ৮ নভেম্বর আয়কর বিভাগে দুর্নীতির উৎস এবং তা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পাঠানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। তাতে দুর্নীতির ১৩টি উৎস এবং সার্বিক দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৩ দফা সুপারিশ ছিল। ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া উষ্মা প্রকাশ করেন। ১১ নভেম্বর আয়কর মেলা নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে দুদকেও নানা ধরনের দুর্নীতি বের হবে। তিনি বলেন, শুধু কর ও শুল্ক বিভাগকে লক্ষ্য করে কোনো কিছু করা হলে এবং এসব বিভাগে দুদকের অফিস করতে চাইলে সেটা হতে দেওয়া হবে না।
দুদকের প্রতিবেদনে চিহ্নিত দুর্নীতির উৎস
প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্য আমদানিতে পণ্যমূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন পরিমাণ, গুণগতমান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই ধরনের পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণ কাস্টম হাউসগুলোর ব্যাপক প্রচলিত অনিয়ম। উচ্চকর আরোপযোগ্য পণ্যগুলোর ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে কম এবং নিম্নহারে কর আরোপযোগ্য পণ্যের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে বেশি দেখানো হয়। এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে অবৈধ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে আমদানিকারকের ঘোষণা অনুসারে শুল্কায়ন করে ওই সব পণ্য খালাস করা হয়।
রেয়াতসংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন বা এসআরওর শর্ত অমান্য এবং আমদানিনীতি, পরিবেশনীতি, অন্য বিধিবিধান ও নীতিমালার শর্ত/নির্দেশনা ভঙ্গ করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা হয়।
কাস্টমস আইন-১৯৬৯–এর বিধান অনুসারে আমদানি করা পণ্য এবং খালাস করা পণ্যের চালান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রায়ই সমন্বয় করা হয় না। আমদানি করা মালামাল নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে খালাস না হলে ওই সব মালামাল নিলামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে তা হয় না।
বিশ্বব্যাপী কাস্টমসের জন্য অটোমেটেড পদ্ধতি চালু থাকলেও বাংলাদেশে কাস্টমস বিভাগ সার্বিকভাবে এখনো এটি চালু করতে পারেনি। এ কারণে কাস্টমস বিভাগের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াগুলো এখনো অস্বচ্ছ এবং সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। এ কারণে তা দুর্নীতির প্রবণতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
আমদানিসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলো আমদানিকারক বা এজেন্সিগুলো কর্তৃক প্রায়ই সঠিকভাবে প্রস্তুত করে না। এ কারণে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়।
কাস্টম হাউসের বন্ডগুলোর (শতভাগ রপ্তানি বন্ড/চামড়া খাতের বন্ড/আমদানি বিকল্প বন্ড/কূটনৈতিক বন্ড শিপ/স্টোরস বন্ড ইত্যাদি) ব্যবস্থাপনা মানসম্মত নয়। এতে বিভিন্ন অনিয়ম, ভোগান্তি, কর ফাঁকি, দুর্নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্র তৈরি হয়।
সমজাতীয় বা প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ট্যারিফ কাঠামোর কারণে কাস্টমসসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে এবং দুর্নীতি বাড়ছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যের অপ্রতুলতা (অপর্যাপ্ত ওজন নির্ধারক/স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা, ফর্ক লিফট, সমন্বিত স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশন), কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ তৎপরতা, গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব এবং পণ্য খালাসের নিরীক্ষা সম্পাদনে অনীহা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।
অস্থায়ী আমদানি বিধির আওতায় বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা গাড়িসহ অন্য পণ্যাদি, বিলম্বিত শুল্ক ব্যবস্থার আওতায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানি করা মালামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং এ প্রক্রিয়ায় আমদানি করা কোনো কোনো মালামাল পুনঃ রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়।
ভ্যাট আইন ও বিধিমালায় অসংগতি, যথা: বিবিধ রেয়াত, মূল্য ও ট্যারিফের নিম্ন ভিত্তি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিদ্যমান ভ্যাট পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো এখনো সনাতন পদ্ধতির। এ ধরনের পদ্ধতি উত্তম চর্চাভিত্তিক ভ্যাট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অনেক সময় রেয়াত নেওয়ার বিপরীতে সঠিক দলিলাদি থাকে না।
পণ্যের শুল্কায়ন চূড়ান্তভাবে সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট আইনে সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক পণ্য ছাড় দেওয়ার বিধান রয়েছে। ফলে, শুল্ক কর্তৃপক্ষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য চালান সাময়িকভাবে শুল্কায়নপূর্বক ছাড় দেয়। কিন্তু পরে অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত শুল্কায়ন করা হয় না। এভাবে দেশের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়।
কাস্টম হাউসগুলোয় ওজন পরিমাপক যন্ত্র, স্ক্যানিং মেশিন, সিসি ক্যামেরা প্রতিনিয়তই অকেজো থাকে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অকেজো করে রাখা হয় মর্মে অভিযোগ আসে। এই সুযোগে অনেক উচ্চ শুল্ক হারের পণ্য কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আমদানিনিষিদ্ধ পণ্য খালাস করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকিসহ আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম বিনষ্ট হয় এবং দুর্নীতি হয়।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সঠিকভাবে তদারকি ও নজরদারি না করার ফলে দুর্নীতিবাজ শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টেদের অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ফলে, দেশের রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি সুবিধাভোগী দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়।
বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত অডিট সম্পন্ন করা হয় না।
বন্ড লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়নে দুর্নীতি হয়। স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্যতা বাড়িয়ে বা মূল্য কমিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোতে শুল্কমুক্ত মদ এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি করে তা ভুয়া প্রাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামে বিতরণ দেখিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। এ কারণে দেশের রাজস্ব ক্ষতি হয়। একইভাবে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রকৃত প্রাপ্যতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি প্রাপ্যতা দেখানো হয় এবং বেশি প্রাপ্যতাকে ধরেই লাইসেন্সে নবায়ন করা হয়।
আমদানি–রপ্তানিতে কিছু অংশ বাদে বন্ড ওয়্যারহাউস কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালি করা হয়। নতুন লাইসেন্স ছাড়া আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম সমন্বয় কিংবা অডিট প্রক্রিয়াটি অত্যধিক কাগুজে দলিলনির্ভর, যার অনেক তথ্য যাচাই–বাছাই করার অবকাশ থাকে। ফলে, এ পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন অডিট করা প্রায় অসম্ভব। যার সুযোগ বন্ড প্রতিষ্ঠান এবং অসাধু কর্মকর্তারা গ্রহণ করে।
বর্তমান মূসকব্যবস্থায় আদর্শ হারে ১৫ শতাংশ হারে মূসক, ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত মূল্যে মূসক পরিশোধের বিধান রয়েছে। ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত ভিত্তি মূল্যে পণ্য/সেবা প্রদানকারীর রেয়াত গ্রহণ করতে না পারায় তারা কাঁচামালের ওপর ভ্যাট পরিশোধ হয়েছে কি না, তা যাচাই করে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কাঁচামাল ক্রয় রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি না করে মূসক ফাঁকি দিয়ে থাকে।
উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয়ের ফলে ভ্যাটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত শ্রম দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, তাদের লক্ষ্যমাত্রা উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হওয়ায় তারা ভ্যাটের পরিধি বাড়িয়ে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন না করে দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে যায়। এ ছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ যোগসাজশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালান (মূসক-১১) জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহককে প্রতারিত করার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়।
শুল্ক ও ভ্যাট অনুবিভাগের শুল্ক ও ভ্যাট আদায়সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকা এবং নিয়োগ বদলি ও পদোন্নতিতে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইনের অভাবে এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশমালা
রাজস্ব গুরুত্বসম্পন্ন এবং উচ্চ ট্যারিফ হারযুক্ত বাণিজ্যিক পণ্য যাদের ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার প্রবণতা রয়েছে—এমন পণ্যসমূহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টম অনুবিভাগের সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ও অংশীজনদের সহযোগিতায় যথাশিগগির সম্ভব চিহ্নিত করে যথাযথ ঘোষণার তথ্য/বিবরণ নির্ধারণ করা যেতে পারে। ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট প্রস্তুত এবং বিল অব এন্ট্রি প্রণয়নের সময় যথাযথ ঘোষণার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
আমদানি–রপ্তানিতে যথাযথ ঘোষণাভুক্ত উপাত্তগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনলাইন সিস্টেম এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণাকেন্দ্রিক দুর্নীতি কমে যাবে।
অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়নপ্রবণতা রোধে ‘ন্যূনতম মূল্য’সংক্রান্ত বিদ্যমান প্রজ্ঞাপন বাতিল যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ঘোষিত পণ্যের পরিমাণ/মূল্য এবং বাস্তব পরিমাণ/মূল্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া গেলে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
শুল্ক বিভাগের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষেত্রে অবারিত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রয়েছে। ওই ক্ষমতা পরীক্ষা করে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এরূপ কাজের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করা এবং নির্ধারিত সময়ে কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পর আগে এলে আগে মূল্যায়ন ভিত্তিতে মূল্যায়ন শেষ করতে হবে। মূল্যায়ন কার্যক্রম থেকে কোনো বিল অব এন্ট্রিকে সাইড লাইনে পাঠাতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা জরুরি।
বন্ডের ভেতরে ও বাইরে এবং পাসবইয়ের তথ্য ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ এবং এসব তথ্যে আলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অডিট কার্যক্রম সম্পাদন করা উচিত।
পণ্য আমদানির নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পণ্য খালাসের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বিধান অনুযায়ী ওই সব মালামাল নিলামের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার মেশিন স্থাপন নিশ্চিত করা এবং আদায় করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমার বিষয়টি নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে।
পণ্য আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর প্রভৃতি মিলে তৈরি ট্যারিফ পণ্যের মিথ্যা ঘোষণাকে প্রভাবিত করে বিধায় তা যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে শূন্য, ৫, ১০, ২৫ শতাংশ শুল্ককাঠামোতে যেসব পণ্য আছে, তাও যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন।
কাস্টমস বিভাগের সোর্স মানি ব্যয় এবং বিভিন্ন উদ্দীপনা পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সব দপ্তরে একই নীতি অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। সোর্স মানি ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি ইউনিটে রেজিস্ট্রার সংরক্ষণসহ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
কল্যাণ তহবিলের মাধ্যমে আর্থিক অব্যবস্থাপনা দুর্নীতির একটি বড় উৎস। এটি রোধকল্পে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং নীতিমালা মোতাবেক স্বচ্ছতার সঙ্গে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এনবিআরের আওতাধীন কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেটসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি-পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় অনেক সময় দুর্নীতি হয়। রাজস্ব কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদায়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। সৎ, মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের কাস্টম হাউস, বন্ড কমিশনারেটসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়ন করা উচিত।
কাস্টমস ও ভ্যাট উভয় বিভাগের গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ই-নথি ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে দ্রুত নথি নিষ্পত্তির পাশাপাশি যেকোনো প্রয়োজনে ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে নথির অবস্থান জানা যাবে।
প্রতিটি কাস্টম হাউসের চোরাচালান দমন বিভাগ শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
কাস্টমসসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ, বিরোধ বা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
এনবিআর প্রদর্শিত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের সঙ্গে অডিট অধিদপ্তর প্রদর্শিত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের পার্থক্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আমদানিকারকদের একটি ডেটাবেইস তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে আমদানিকারকদের বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এর ফলে শুল্কায়ন শেষ হলে (শুল্ক-করাদির পরিমাণ) আমদানিকারক ই-মেইল, এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পারবেন।
যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম অটোমেটেড সম্পাদনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সেকেন্ড অ্যাপ্রেইজমেন্ট পুরোপুরি বন্ধ করে পিসিএ বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
হাতে হাতে কিংবা সশরীরে উপস্থিত হয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে অনলাইন পদ্ধতি এবং কাস্টমসের হলরুমে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করলে দুর্নীতি কমে যাবে।
কোনো চালান যে কর্মকর্তা বন্ধ করবেন, তা ওই একই কর্মকর্তা কর্তৃক খোলার বিধান পরিবর্তন করে খোলার ক্ষমতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
বন্ড প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার বন্ধ করতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করার বিকল্প নেই। এর ফলে বন্ডসংক্রান্ত তথ্যে সহজে প্রবেশ করা যাবে। সব তথ্যের ভান্ডার থাকলে এবং সেখানে সহজে প্রবেশাধিকার থাকলে দুর্নীতি কমবে।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট তদারকি করতে হবে। মানসম্পন্ন অডিট নিশ্চিত করতে পারলে বন্ড প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার কমবে, যার ফলে অসাধু কর্মকর্তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড কমানো সম্ভব হবে।
নতুন বন্ড লাইসেন্স দেওয়ার সময় এবং নবায়নে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করা যেতে পারে। বন্ড ব্যবস্থায় আমদানি করা পণ্য যথাযথভাবে বন্ড গুদামে প্রবেশ এবং ইন টু বন্ড হয়েছে কি না, সে বিষয়ে বন্ড কর্মকর্তা মাসিক প্রতিবেদন দেবেন।
সব ক্ষেত্রে আদর্শ হারে মূসক প্রযোজ্য হবে এবং রেয়াত গ্রহণের সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ট্যারিফ বা সংকুচিত ভিত্তিমূল্য থাকবে না। প্রয়োজনে নিট প্রদত্ত টাকার একটি নির্দিষ্ট অংশ রিফান্ড দেওয়া যাবে—এমন বিধান রাখা যেতে পারে।