চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর মহাপরিকল্পনায় জায়গাটি নতুন সড়কের জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু সেখানে সিডিএ ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এখন সড়ক বানাতে গিয়ে ভাঙতে হচ্ছে ভবনটি। এতে ভবনমালিককে দিতে হচ্ছে প্রায় ১১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। শুধু তা–ই নয়, এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেড়েছে এক বছর। আর খরচ বেড়েছে ১৫ কোটি টাকা।
সিডিএ সূত্র জানায়, আগামী নভেম্বরে ভবনটি ভাঙা হবে। ফ্ল্যাট খালি করে দিতে এরই মধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের ডিসি রোড এলাকায় বাবে ইউসুফ নামের ১০ তলা ভবন নির্মাণ করে হাজী চান্দমিয়া সওদাগর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। এতে ৩৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
সিডিএর নথি অনুযায়ী, সংরক্ষিত জায়গায় ভবন অনুমোদনে ‘ঘোরতর’ অনিয়ম হয়েছে। তা তদন্তের জন্য বোর্ড সদস্য মো. গিয়াস উদ্দিনকে প্রধান করে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আড়াই বছরে কোনো কাজ করেনি। গিয়াস উদ্দিন দাবি করেন, তাঁরা কমিটি গঠনের কোনো চিঠি পাননি।
এ ঘটনার তদন্ত না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল। ২১ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ অনুমোদন–প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। এখন কমিটি পুনর্গঠন করে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ।
ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গাটি ‘বাকলিয়া সংযোগ সড়কের’ জন্য সংরক্ষিত রাখার নির্দেশনা ছিল সিডিএর মহাপরিকল্পনায়। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০ ফুট প্রশস্ত এই সড়কের প্রকল্প ব্যয় ছিল ২০৫ কোটি টাকা। এখন ব্যয় হচ্ছে ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। নগরের সিরাজউদ্দৌলা সড়ক থেকে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক পর্যন্ত বাকলিয়া সংযোগ সড়ক নামে নতুন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।
সিডিএর প্রকল্প পরিচালক আহমদ মঈনুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএর অনুমোদন থাকায় ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এই একটি ভবনের কারণে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প ঝুঁকিতে পড়েছিল।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের প্রান্তে রাস্তার কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। তবে ১০ তলা ভবনের সামনে-পেছনের অংশে কাজ বন্ধ রয়েছে। এর সীমানাপ্রাচীরে লাল দাগ দেওয়া হয়েছে।
ভবনমালিকদের একজন মোহাম্মদ ইকবাল জানিয়েছেন, নিয়মনীতি মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
যেভাবে অনুমোদন
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগরের ডিসি রোড এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইকবালসহ ৯ ব্যক্তি ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের (এলইউসি) জন্য ২০১০ সালের ১৩ মে আবেদন করেন। এই নকশায় জমির দৈর্ঘ্য ১৮৭ দশমিক ১৩ মিটার এবং প্রস্থ ২২ দশমিক ৫৫ মিটার দেখানো হয়। তবে এতে সড়কের জন্য ৯১ বর্গমিটার সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়ে নকশা দেওয়া হয়। এই নকশায় নকশাবিদ আতিকুল ইসলাম, সহকারী নগর–পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ও নগর–পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষর করেন। ওই বছরের ১৪ জুলাই সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র সনদ দেওয়া হয়।
প্রায় ছয় মাস পর জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে সনদ সংশোধনের জন্য আবেদন করেন মোহাম্মদ ইকবাল। সংশোধিত নকশায় রাস্তার জন্য জমি ছাড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি না করায় আতিকুল ইসলাম স্বাক্ষর দেননি। অন্য দুজন স্বাক্ষর করেন।
এ বিষয়ে সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, সহকারী নগর–পরিকল্পনাবিদ ও জিআইএস অপারেটররা মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে নথি দিয়েছেন। তাতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান দাবি করেছেন, তদন্ত কমিটি তাঁদের অবহেলা খুঁজে পায়নি।
ইমারত নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান দাবি করেন, বাস্তবে যে পরিমাণ জায়গা আছে, তার দ্বিগুণ জমি দেখিয়ে নকশা জমা দিয়েছিলেন ভবনমালিক। ফলে রাস্তার জন্য জায়গা নির্ধারিত থাকার বিষয়টি দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তবে নকশায় নকশাবিদের স্বাক্ষর না থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, উনি (আতিকুল ইসলাম) জানতেন বিষয়টি।’
নকশাবিদ আতিকুল ইসলাম বলেন, সহকারী নগর–পরিকল্পনাবিদ আশরাফুজ্জামান নকশাটি তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। দাপ্তরিক নথির মাধ্যমে না আসায় তিনি নকশায় স্বাক্ষর করেননি।
সিডিএর নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১০ তলা ভবনের চূড়ান্ত নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে নতুন সড়কের জন্য সংরক্ষিত জায়গা চিহ্নিত করার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি সহকারী অথরাইজড কর্মকর্তা মো. ইফতেখার ও অথরাইজড কর্মকর্তা মোহা. মনজুর হাসান।
২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ইমারত নির্মাণ কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিনটি শর্তে নির্মাণ অনুমোদনপত্র ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিল ভবনের নকশা জ্যেষ্ঠ স্থপতির যাচাই সাপেক্ষে অনুমোদিত হবে। কিন্তু তা করা হয়নি।
এ বিষয়ে সিডিএর তিন প্রকৌশলী ও এক নগর–পরিকল্পনাবিদের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নথিপত্র জ্যেষ্ঠ স্থপতির কাছে পাঠানো হলে অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ার সুযোগ ছিল। তখন রাস্তার জায়গায় ভবন নির্মাণের অনুমোদনের বিষয়টি আটকে যেত। পুরো প্রক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, এটি অনিচ্ছা কিংবা অসতর্কতাজনিত ভুল নয়, ইচ্ছাকৃত ভুল।
সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষও মনে করেন, ভবনমালিক নন, সিডিএর যাঁরা নকশা অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁদের দোষ থাকতে পারে।