কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতেন সম্রাট

যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন ওরফে সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর কাকরাইলে তাঁর কার্যালয়ে তাঁকে নিয়ে অভিযান চালায় র‍্যাব। অভিযান শেষে কাকরাইল থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে। গতকাল সন্ধ্যা সাতটায়। ছবি: সাজিদ হোসেন
যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন ওরফে সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর কাকরাইলে তাঁর কার্যালয়ে তাঁকে নিয়ে অভিযান চালায় র‍্যাব। অভিযান শেষে কাকরাইল থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে। গতকাল সন্ধ্যা সাতটায়। ছবি:  সাজিদ হোসেন

আক্ষরিক অর্থেই নামের সার্থকতা ছিল তাঁর। চালচলন ছিল সম্রাটের মতোই। খাবার খেতেন পাঁচ তারকা হোটেলে, পান করতেন বিদেশি পানি। ছিল জলসাঘরও। পথে বের হলে সামনে-পেছনে থাকত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের বহর। আয়ের উৎস ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজি। অনেক জল্পনার পর সেই ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের হাতে পড়ল হাতকড়া।

গতকাল রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এ সময় সঙ্গে থাকা যুবলীগের আরেক নেতা এনামুল হক ওরফে আরমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁদের ঢাকায় এনে বাসা ও অফিসে পৃথক তল্লাশি চালায় র‍্যাব। সেখান থেকে বন্য প্রাণীর দুটি চামড়া, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, ১ হাজার ১৬০টি ইয়াবা বড়ি, একটি অস্ত্র, বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র ও মারধর করার লাঠি উদ্ধার করেছে র‍্যাব। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আর গ্রেপ্তারের সময় মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন আরমান। এ কারণে তাঁকেও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সন্ধ্যায় সম্রাটকে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সন্ধ্যায় আরমানকে হেলিকপ্টারে করে ফেনীতে নিয়ে যায় র‍্যাব। রাতে তাঁকে ফেনী থেকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে সকালে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাঁদের বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।

ছাত্ররাজনীতি থেকে যুবলীগের রাজনীতিতে এসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হন সম্রাট। তাঁর ক্ষমতার হাত ছিল বেশ লম্বা। সরকারি দলের বড় পদে থাকায় গডফাদার ভাবমূর্তির সম্রাট ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও ঢালতেন। সে কারণে ক্যাসিনো-কাণ্ডে অনেকে ধরা পড়ার পরও সম্রাট ধরা পড়বেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল দলসহ অনেকের ভেতরেই। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ফজলে নূর তাপস শনিবার এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। তিনি জানতে চান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন সম্রাটকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তাঁর বক্তব্যের পর রাত পোহাতে না-পোহাতেই আটক হন সম্রাট। আর এর মধ্য দিয়ে তছনছ হয়ে গেল কোটি কোটি টাকার ক্যাসিনো-সাম্রাজ্য।

সাংসদের বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সম্রাটকে গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা কেন বাস্তবায়িত হলো না? ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের দায়িত্বে থাকা সংস্থা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সাংসদের এই কথিত অভিযোগের জবাব দেওয়া শোভন হবে না।’

তাহলে এত দিন কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা থেকে বিরত থাকল র‍্যাব? এ প্রশ্নের জবাবে বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘এটা অমূলক প্রশ্ন। এতে করে অনেক কষ্ট করে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে যাঁরা এই অভিযান চালিয়েছেন, তাঁদের খাটো করে দেখা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রশ্নটা এমন যে মনে হচ্ছে গ্রেপ্তারকৃত ভদ্রলোক জিরো পয়েন্টে বসে পথিকদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন এবং হাত মেলাচ্ছেন আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাসায় বসে আরাম করছে।’

গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র‍্যাব। অভিযানের পর সবাই নিশ্চিত হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতারাই মূলত এই ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রথম দিন চারটি ক্লাবে অভিযানের সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকেরা মনে করছিলেন, ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রকই হলেন সম্রাট।

শুধু তা-ই নয়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে যুবলীগ নেতা সম্রাটের নাম আসতে থাকে। অভিযানে যুবলীগ, কৃষক লীগের কয়েকজন নেতা র‍্যাব ও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সম্রাট সে সময় দৃশ্যমান ছিলেন। তিনি ফোনও ধরেছেন। কয়েক দিন কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অবস্থানও করেছেন। ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অবস্থানকালে শতাধিক যুবক তাঁকে পাহারা দিয়েছেন। সেখানেই সবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একদিন হঠাৎ করেই অজ্ঞাত স্থানে চলে যান সম্রাট। এরপর থেকে তাঁর অবস্থান নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়। সেই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছিল, সম্রাট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে আছেন। তারা দোটানায় ছিল ধরবে কি ধরবে না। কিন্তু অভিযানের ১৭ দিন পরে তাঁকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এর আগে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে সম্রাটকে ঢাকা থেকে আটক করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, সম্রাট আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছিলেন।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক অবশ্য জোর দিয়ে বলেন, কুমিল্লা থেকেই সম্রাটকে আটক করা হয়েছে।

অভিযান শুরুর পর গত ২২ সেপ্টেম্বর সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি আদেশ দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে পাঠানো হয়। তাঁর ব্যাংক হিসাবও তলব করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, সম্রাটের ব্যাংক হিসাবে কী পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে, তার হিসাব দিতে। সেসব হিসাবপত্র এখনো জমা হয়নি।

গত সংসদ নির্বাচনের আগে এক সমাবেশে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে সম্রাট। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা থেকে সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর প্রথমে উত্তরায় র‍্যাব সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। এরপর কড়া পাহারায় বুলেটপ্রুফ পোশাক ও হাতকড়া পরিয়ে সম্রাটকে নেওয়া হয় কাকরাইলে তাঁর নিজের কার্যালয়ে। পরে তাঁর অফিস ও দুই বাসায় একযোগে অভিযান চালানো হয়। একই সময় সঙ্গী আরমানের কলাবাগান ও মিরপুর-২-এর বাসায়ও অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানের সময় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

তল্লাশির সময় সাংবাদিকেরা জানতে চান, এত দিন তল্লাশি না করে কি সবকিছু সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো না? জবাবে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, তদন্তের পরই সবকিছুর জবাব দেওয়া যাবে।

সম্রাটের রাজনীতি
ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট যে কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অফিস খুলে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন, সে খবর কারও অজানা ছিল না। একসময় তিনি ‘গডফাদার’দের পক্ষে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-তদবির করতেন, শেষের দিকে তাঁকে আর অফিস থেকে বেরোতে হতো না। টাকা অফিসে পৌঁছে যেত। অপরাধজগতের এই অঘোষিত সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তারপরও গত নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। ভবিষ্যতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে মেয়র পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তিনি। ঢাকায় আওয়ামী লীগের মিছিল-সমাবেশে লোক সরবরাহ করতেন তিনি।

একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সম্রাটের রাজনৈতিক গুরু আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বিভিন্ন সময় যুবলীগের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল সম্রাটের। সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে সাংসদ নূরুন্নবী চৌধুরী ওরফে শাওনের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন সম্রাট। ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট শাওনের পিস্তলের গুলিতে দেহরক্ষী ইব্রাহীম নিহত হলে সম্রাটের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন শাওন। ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে শাওনের একটি অফিসও রয়েছে।

সম্রাটের রাজনৈতিক সহকর্মী ও পরিবারের লোকজন বলছেন, ২০১২ সালের পর অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন সম্রাট। ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে প্রথম তাঁর একটি অফিস ছিল, পরে পুরো আটতলার দখল নেন। এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন ঢাকার অপরাধজগৎ।

স্ত্রীকে বলেছিলেন তিনি গরিব
সম্রাটের স্ত্রী শারমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মহাখালী ডিওএইচএসে তাঁদের একটি বাড়ি ও একটি ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। এর বাইরে তাঁর জানামতে নিজের আর কোনো সম্পদের খবর তিনি জানেন না। ২০০২ সালে যখন তাঁর বিয়ে হয়, তখন সম্রাটের কাকরাইলের বিপাশা হোটেলের মালিকানা ছিল। তাঁর স্বামীর দৃশ্যমান পরিবর্তনের শুরু ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি হওয়ার পর। স্ত্রীর কাছে অর্থসম্পদের কোনো খবর প্রকাশ করতেন না সম্রাট। শারমিনের আগে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন তিনি। সে ঘরে একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।

জানা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে—এ আশঙ্কায় সম্রাট ২০১৩ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন ও ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেন। বছর দুয়েক শারমিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন। ছেলেকে রেখে তিনি ফিরে আসেন। কিন্তু সম্রাট আর বাড়ি ফেরেননি। তিনি স্ত্রীকে বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ায় তাঁর পক্ষে সিঁড়ি ভাঙা সম্ভব না। আর আলাদা বাসা ভাড়া নেওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর নেই। তিনি ‘গরিব’।

শারমিন সাংবাদিকদের গতকাল বলেন, ‘ক্যাসিনো সম্রাটের নেশা। ক্যাসিনো থেকে যা আয় করত, তা দিয়ে দল চালাত আর সিঙ্গাপুরে গিয়ে জুয়া খেলত।’

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সম্রাট জুয়া খেলতে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে যেতেন সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে রিসোর্টে বছরে অনেকবার জুয়া খেলতে যান তিনি।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা আরমানও দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনোর কারবারে জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকাই সিনেমায়ও টাকা খাটাচ্ছিলেন। আরমানের প্রোডাকশন হাউস ‘দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া’র ব্যানারে প্রথম সিনেমা মনের মতো মানুষ পাইলাম না মুক্তি পায় গত কোরবানির ঈদে।