২৬ জুন সকালে রিফাত শরীফ সাদা রঙের মোটরবাইকে করে বরগুনা সরকারি কলেজের ফটকে আসেন। বাইক ফটকের বাইরে রেখে তিনি কলেজে ঢোকেন। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে আসেন রিফাত ফরাজী। আরও দুই থেকে তিন মিনিট পর রিফাত ফরাজীর দু-তিন সঙ্গী কলেজে ঢুকে পড়েন। রিফাত শরীফ ও তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছেন। রিফাত ফরাজীর দলবলকে দূর থেকে দেখে স্বামীকে টেনে ধরে ফের কলেজে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন আয়শা। পারলেন না তিনি। টেনেহিঁচড়ে রিফাতকে বের করে এনেই কোপ। প্রথমটি রিফাত ফরাজীর ও পরেরগুলো নয়ন বন্ড ও অন্যদের।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নতুন একটি ভিডিও ফুটেজ থেকে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের এই বিবরণ পাওয়া গেছে।
ফুটেজে রিফাত ফরাজীকে দেখা যায় কালো জামা ও চোখে কালো চশমা পরা অবস্থায়। এ সময় তাঁর ছয়-সাতজন সঙ্গী অপেক্ষা করছিলেন কলেজ গেটের বাইরে। মিনিট দুয়েক পর রিফাত ফরাজী তার দু-তিনজন সঙ্গীকে কলেজের ভেতরে পাঠান। হাতে মুঠোফোন নিয়ে রিফাত ফরাজী নিজে কলেজ গেটের সামনের রাস্তার উত্তর পাশে অবস্থান নেন। তাঁকে তিন-চারজনকে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়। তিনি তরুণদের কলেজ গেটের উল্টো দিকে অবস্থান নিতে বলেন। পরে রিফাত শরীফ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কলেজ গেট থেকে বের হন। তাঁরা মোটরসাইকেলে উঠে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হঠাৎ রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা রিফাত ফরাজী ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দেখে স্বামীকে ভেতরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পৌঁছানোর আগে রিফাত ফরাজীর নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী রিফাত শরীফকে ধরে ফেলে। কিল, ঘুষি দিতে দিতে মূল ফটকের সামনের সড়ক থেকে পুব দিকে নিয়ে যায় তারা। সেখানেই প্রথম দেখা যায় নয়ন বন্ড ও অন্য সন্ত্রাসীদের। নয়ন বন্ডের কাছে রিফাত শরীফকে নিয়ে যাওয়ার পর ১৫-১৬ জন তাঁকে ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করে। এ সময় রিফাত ফরাজী ও তাঁর অপর এক সহযোগী দৌড়ে কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে রাখা দুটি রামদা নিয়ে আসেন। এর একটি রামদা নয়নের হাতে দিয়ে রিফাত ফরাজী প্রথমেই রিফাত শরীফকে কোপাতে শুরু করেন। এরপর রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ড দুজনে মিলে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন রিফাত শরীফকে। আর সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যান স্ত্রী আয়শা।
নতুন এই ভিডিওতে দেখা যায়, রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করার পর সন্ত্রাসী রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ড রামদা হাতে সবার সামনে দিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে ঘটনাস্থলের পশ্চিম দিকে চলে যান। তখন রিফাত শরীফের রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা পথ।
ভিডিওটি দেখে মনে হয়েছে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড ছিল সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত। কেউ কিছু আঁচ করার আগেই তাঁরা এই হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন।
নতুন ভিডিওতে দেখা যায়, রিফাত শরীফকে কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে থেকে ধরে আনা, হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বন্ড-০০৭–এর সদস্যদের ঘটনাস্থলে জড়ো করা, কোপানোর জন্য লুকিয়ে রাখা রামদা আনা এবং প্রথম কোপটি দেন এই রিফাত ফরাজী। ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের মূল গেটের সামনে স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে বেধড়ক কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় রিফাত শরীফকে। ওই দিন বেলা তিনটায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
>
- গত ২৬ জুন প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয় রিফাত শরীফকে
- এদিনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত শরীফ মারা যান
- এই হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন
- ৬ জন ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন
- মামলার আসামি নয়ন বন্ড গ্রেপ্তারের পর ক্রসফায়ারে নিহত হন
এ ঘটনায় পরের দিন রিফাতের বাবা আবদুর হালিম শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে এবং ৪-৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন।
এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, ৬ জন এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল শনিবার জবানবন্দি দিয়েছেন সাগর ও নাজমুল ইসলাম। এর আগে চন্দন, মো. হাসান, অলিউল্লাহ ও তানভীর হাসান জবানবন্দি দিয়েছেন। এই চারজনের মধ্যে প্রথম তিনজন এজাহারভুক্ত আসামি। এ ছাড়া মামলার আসামি নয়ন বন্ড গ্রেপ্তারের পর পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে নিহত হন।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁরা রিফাত শরীফকে কোপানোর সময় সেখানে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপ ‘বন্ড ০০৭ ’-এ বার্তা পেয়ে তাঁরা ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন। হত্যা পরিকল্পনা সম্পর্কে গ্রুপে আগাম কোনো আলোচনা হয়নি। তাই তাঁরা জানতেন না। এই হামলার নেতৃত্বে ছিলেন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী এবং রিফাতের ছোট ভাই রিশান ফরাজী। তাঁদের মধ্যে রিশান এখনো গ্রেপ্তার হননি।
এক কর্মকর্তা জানান, অলিউল্লাহ, তানভীরসহ অন্যরা জবানবন্দিতে বলেছেন, এই হামলায় বন্ড ০০৭ গ্রুপের অন্তত ২০ জন ছোট দলে ভাগ হয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। হামলার সময় পথচারী বা রিফাত শরীফের দলের কেউ যেন এগিয়ে আসতে না পারে, তা সামলানোর দায়িত্ব ছিল একটি দলের। হামলার পর সবাই যেন বিনা বাধায় পালাতে পারে তা নিশ্চিতে পাহারায় ছিল আরেকটি পক্ষ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির গতকাল বিকেলে বলেন, এসব বিষয় নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। রিফাত ফরাজী সাত দিনের রিমান্ডে আছেন। এরই মধ্যে চার দিন পার হয়েছে। রিমান্ডে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় নতুন ভিডিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।