মেয়েটির খবরটা পড়ার পর থেকেই একঝটকায় ভাবনাটা চলে গেল ঘটনার ঠিক আগের সময়ে। মেয়েটি নিশ্চয় বাবার কথা ভাবতেই ভাবতেই তার কাপড়চোপড় ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছিল। হয়তো ভাবছিল, ঢাকার চিকিৎসকেরা বাবাকে নিয়ে ভরসা দেবেন তো! হয়তো ভাবছিল, মায়ের সঙ্গে বাবার দেখভালে সে আগের চেয়ে আরও নজর দেবে। চিকিৎসকের পরামর্শের সবটুকু অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। নানা ভাবনা নিয়ে ব্যাগ গোছাতে থাকা মেয়েটি নিশ্চয় কল্পনাও করেনি বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
১২ জুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নবম শ্রেণির এই মেয়েকে (১৫) ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ওই দিন সকালেই নানাবাড়ি থেকে মেয়েটি নিজ বাড়িতে আসে। বাবা ক্যানসারের রোগী। মা তাকে নানার বাড়ি রেখে চিকিৎসার জন্য বাবাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে দেখভালের জন্য মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সে বাড়ি আসে। বাড়িতে একা পেয়ে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
খবরটা পড়ার পর থেকে অচেনা মেয়েটার সঙ্গে এ ঘটনা না ঘটলে কী হতে পারত, সেসব অসম্ভব কল্পনার দিকে মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছিল। মেয়েটা বিচার পাবে তো? কল্পনার ভাবনা বাস্তবে এসে ধাক্কা খায়। বিষণ্ন মনটাকে প্রকৃতির শাস্তির প্রত্যাশার কাছে সমর্পণ করতে ইচ্ছা করে। যেন ঐশ্বরিক শাস্তির বিধান দিতে হাজির হোক প্রতিশোধের দেবী নেমেসিস। তলোয়ার, দাঁড়িপাল্লা দিয়ে চিত্রিত গ্রিক দেবী নির্দয়ভাবে দমন করুক দুষ্টের। যাতে মেয়েটিই হয় শেষ অপরাধের ঘটনা। সহিংসতার আধিক্য দেখে, এমন ভয়াবহতা দেখে বিপর্যস্ত মনে কখনো কখনো প্রতিশোধের জন্য একজন নেমেসিসের আগমনের প্রার্থনা জেগে ওঠে।
এত সব ভাবনার মধ্যে যাঁরা ১২ জুন তারিখটার দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, ‘এই সময়েও মানুষ এত নৃশংস হতে পারে!’ তাঁদের মন আরও ভারাক্রান্ত করার জন্য এমন ভয়াবহ তথ্য আরও রয়েছে। সত্যিই তাই! ‘এই সময়’ বলতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি। বিশ্বজুড়ে চলমান এই দুর্যোগে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য হা–পিত্যেশ করছে, তখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কিছু অপরাধী নির্দ্বিধায় নির্যাতন–নৃশংসতা করেই চলছে। অপরাধের মাত্রা ও ক্ষেত্রের হেরফের হলেও অপরাধ থামেনি।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) জানিয়েছে, লকডাউনের সময় গত মে মাসে ৩১ দিনে দেশের ৫৩টি জেলায় ১৩ হাজার ৪৯৪ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। ৫৩ হাজার ৩৪০ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই টেলিফোনিক জরিপে বলা হয়, নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতনের হার বেড়েছে ৩১ শতাংশ। গত মে মাসে ১৯ শিশু–কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৯ জন মেয়ে। ১৩টি মেয়েশিশু ও ৬টি ছেলেশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ত্রাণ নিতে গিয়ে তিনজন মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।
‘আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন’
লক্ষ্মীপুরের মেয়েটির মামলার বিষয়ে জানতে প্রথম আলোর লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি এ বি এম রিপনের কাছ থেকে মেয়েটির মায়ের মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করলাম। ফোনে কথা বলার আগে কী জিজ্ঞেস করব মনে মনে গুছিয়ে নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, মেয়েটিকে নিয়ে আবেগের কথা তুলে সদ্য সন্তানহারা মাকে ঝরঝর করে কাঁদাব না। ফোন করে পরিচয় দিয়ে মেয়েটির মামলার অবস্থা জানতে চাইলাম।
মেয়েটির মা জানালেন, এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন চারজনকে পুলিশ আটক করেছে। আপনি কাকে সন্দেহ করেন? জবাবে বললেন, ‘আমি কাউকে সন্দেহ করি না। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। কেউ কিছু দেখেনি, কেউ কিছু বলতে পারেনি। আমি ওর বাবাকে নিয়ে ছিলাম ঢাকায়। মেয়ে ওই দিনই নানার বাড়ি থেকে বাসায় গেল। পরদিন ১৩ জুন আমার এক চাচা–শ্বশুরের সঙ্গে ওর ঢাকায় আসার কথা।’ মা বলে চললেন, ‘সকাল নয়টায়ও ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বেলা তিনটায় শুনি, মেয়ে নেই। ওর দাদি দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে গিয়ে দেখে এই অবস্থা!’ মেয়েটির মায়ের কাছ থেকে জানলাম, মেয়েটির লাশের কাছেই পড়ে ছিল বাবার কাছে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে রাখা ব্যাগটি।
মেয়েটির মা জানালেন, খবর পেয়ে তাঁরা ঢাকা থেকে গ্রামে যান। সেখানে দাফন শেষে আবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মেয়েটির বাবা ভর্তি রয়েছেন। তাঁর মস্তিষ্কে ক্যানসার। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়েটি ছিল বড়। হাসপাতালে তাঁদের সঙ্গে এখন মেয়ে (১০) ও ছেলে (১) রয়েছে। এলাকার লোকজন আর আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন দিনমজুর স্বামীর। বললেন, ‘মেয়ের বাবার এই অবস্থা, আর মেয়েটাও নাই। আমার মেয়েটার জন্য আপনারা দোয়া করবেন। খুনিরা যেন শাস্তি পায়।’
নিজের বাড়িতে মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা পরিবারটির জন্য দগদগে ঘা হয়ে থাকবে বহু বছর—কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো হাজারবার তাঁরা আফসোস করবেন, এটা না করলে, ওটা না করলে এই ঘটনা ঘটত না। মনে হবে, যা ঘটেছে তা দুঃস্বপ্ন, ঘুম ভাঙলেই আবার সব যা ছিল তা–ই হবে। যেমন ১৮ বছর আগের আনফেইথফুল ছবির কোনি বা হালের ফ্র্যাকচার্ড সিনেমার রে চরিত্রটিকে দেখা গিয়েছিল ঘটনা পাল্টে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে। ২০০২ সালে রিচার্ড গিয়ার আর ডায়ান লেইন অভিনীত হলিউডের আনফেইথফুল ছবিতে দেখা যায় কোনির ভূমিকায় অভিনয় করা ডায়ান লেইন রাস্তায় হঠাৎ এক যুবকের সঙ্গে দেখা হওয়ার জেরে বিপর্যয়ে পড়েন। এ নিয়ে পরে তিনি আফসোসের সঙ্গে ভাবেন, ‘ইশ্! যুবকের সহায়তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তিনি যদি চলে আসতেন!’
আর মার্কিন প্যারাসাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফ্র্যাকচার্ড সিনেমায় দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও শিশুকন্যার মৃত্যুর ঘটনা মেনে না নিয়ে রে অসম্ভব সব কাণ্ড ঘটাতে থাকে।
জীবন সত্যি সিনেমার চেয়েও অনেক কঠিন, অনেক নৃশংস। তা না হলে দুর্যোগের এই অবরুদ্ধ সময়ে মেয়েটির এমন মৃত্যু নিয়ে আমাদের বিষণ্নতা আর বেদনার মধ্যে আরও অনেক উদাহরণ হাজির করতে হতো না। আপনি যখন এই সময়ে আপনার শিশুকন্যার সুরক্ষা ও নিরাপত্তাকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে ঘরবন্দী সময় কাটাচ্ছেন, তখন কেরানীগঞ্জে ১০ বছর বয়সী এক শিশু ত্রাণ নেওয়ার জন্য সরল বিশ্বাসে চলে যায় অন্য লোকের পিছু পিছু। ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে ঘরে আটকে ধর্ষণ করা হয়। ঘটনাটি ঘটে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে লকডাউনের মধ্যে।
গত ২৩ মার্চ ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় ১৬ বছর বয়সী কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে গাছে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। ওই ঘটনায় মুয়াজ্জিনসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ।
মার্চের শেষ সপ্তাহে জামালপুরে কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী তল্লাশির কথা বলে পুলিশ পরিচয়ে ঘরে ঢুকে এক কিশোরীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়।
চার বছর বয়সী নিজের মেয়েকে ধর্ষণের মামলায় এক বাবাকে গত ২৬ মার্চ যশোরের সদর উপজেলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘জীবনের অনেক চাওয়া–পাওয়ার কবর দিলাম’
এক মাস ধরে ফেসবুক মেসেঞ্জারে দৈনিক সমকাল–এর নিজস্ব প্রতিবেদক সাজিদা ইসলাম পারুলের (৩৫) সঙ্গে কথা হয়। তাঁর স্বপ্নভঙ্গের কথাগুলো শুনি। তাঁর জুতা পায়ে গলিয়ে কষ্টটা উপলব্ধি করি। বিয়ের এক মাসের মধ্যে স্বামী দৈনিক যুগান্তর–এর প্রতিবেদক রেজাউল করিম ওরফে প্লাবন (৩৭) বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছেন। লকডাউনের মধ্যে স্ত্রীকে একা ঢাকার ভাড়া বাসায় রেখে তিনি অবস্থান করছিলেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পাত্রখাতা রহমান হাজির গ্রামে নিজ বাড়িতে। স্বামী কেন বিচ্ছেদ চাইছেন, তা ফোনে একাধিকবার জানতে চেয়েও সদুত্তর পাননি। পরে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য গত ৫ মে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ওই গ্রামে যান পারুল। পরে ঢাকায় ফিরে ১১ মে হাতিরঝিল থানায় স্বামীসহ পাঁচজনকে আসামি করে যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যার অভিযোগ জানিয়ে মামলা করেন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর মধ্যে ১১ হাজার ২৫ জন অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ঘটেছে স্বামীর হাতে।
পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৫ শতাংশ নারী, ৪ হাজার ৯৪৭ জন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৯ জন (৩৩ শতাংশ), শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৮৫ জন (১৯ শতাংশ) এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৪০৪ জন (৪ শতাংশ)।
পারুলের করা মামলার এজাহার অনুসারে, গত ২ এপ্রিল তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর একাধিক অনৈতিক সম্পর্কের কথা তিনি জানতে পারেন এবং শারীরিক–মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। বিয়ের পরই স্বামী পারুলের বাবার কাছ থেকে ফ্ল্যাট বা নগদ ৫০ লাখ টাকা এনে দিতে বলেন। পারুল জানান, ঢাকার এক প্রান্তে তাঁর বাবার বাড়ি থাকলেও শুধু তাঁর জন্য তিনি কেন ওই বাড়ি বিক্রি করতে বলবেন! ৫ মে তিনি স্বামীর গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পর স্বামীর পরিবারের লোকজন তাঁকে মারধর করেন। তাঁর সঙ্গে থাকা স্থানীয় সাংবাদিকেরা তাঁকে উদ্ধার করে চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। পরের দিন তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই সময়ে তাঁর গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।
স্ত্রীর অভিযোগকে মিথ্যাচার উল্লেখ করে মুখোশ উন্মোচিত হবে বলে নিজের ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন স্বামী রেজাউল।
কথা বলার একপর্যায়ে পারুল আক্ষেপ করে বললেন, ‘জীবনের অনেক চাওয়া–পাওয়ার স্বপ্ন কবর দিয়ে দিলাম আপু। আমি মা হতে গিয়েও পারলাম না। আহ্! এ যে কী কষ্টের, কেমনে বোঝাই। কেউ বোঝে না! আমি আর হাসতে চাই না আপু। আমার হাসি আমার কাল। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। আমার সব খুশি কেড়ে নিল।’
গত ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে ধারণা দেওয়া হয়।
পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা তুলে ধরতে গিয়ে ঢাকার এক গৃহবধূ জানালেন, এই লকডাউনে দৈনন্দিন কাজ আর শ্বশুর–শাশুড়ির যত্ন করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাঁর প্রায় প্রতিদিন কলহের ঘটনা ঘটেছে। স্বামী প্রতিটি কাজে তাঁর খুঁত ধরতেন। অন্য সময়ের চেয়ে লকডাউনের সময় বাড়িতে কাজের চাপও বেশি ছিল। প্রতিটি বিষয়ে স্বামীর খবরদারি তাঁর কাছে অসহনীয় লাগত। বিশেষ করে একদিন শ্বশুরকে খাবার দিতে দেরি করা নিয়ে স্বামী তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
নারীবাদী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রাগ্রসর–এর নির্বাহী পরিচালক (সম্মানসূচক) ফওজিয়া খোন্দকারের মতে, লকডাউনে বাড়িতে থাকা পুরুষটি পারিবারিক সব কাজে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। মতের অমিল থেকে কলহ, সংঘাত ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, গত ২৭ মার্চ সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ঝগড়ার জের ধরে এক ব্যক্তি অ্যাসিড ছুড়ে তাঁর স্ত্রীর মুখ ঝলসে দেন।
পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে ৪ জুন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় মা–মেয়ে খুন হন।
পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় বিয়ের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ১৯ জুন স্বামী ও স্বামীর প্রথম স্ত্রীর হাতে খুন হন এক গৃহবধূ।
২০ জুন সিরাজগঞ্জে যৌতুকের কারণে গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন স্বামী ও ননদ।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের মতে, দুর্যোগে নারীর অভিজ্ঞতা হয় অন্যদের চেয়ে ভিন্নভাবে। করোনাভাইরাসের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছে পরিবারগুলো। বাড়ির উপার্জনকারী পুরুষ এই অনিশ্চয়তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে পরিবারের নারী সদস্যটিকে শারীরিক–মানসিক নির্যাতন করছেন।
ব্র্যাক জানিয়েছে, লকডাউনের সময়ে ১১টি জেলায় পরিচালিত সংস্থার জরিপে ৩২ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁদের পরিবার ও পাড়ায় কাজ হারিয়ে অথবা আয় কমে যাওয়ায় পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে।
‘মেয়েটির কেউ নেই’
গত ৮ মে ১৫ বছর বয়সী এক গৃহকর্মী রাজধানীর বাড্ডা থানায় গৃহকর্তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে। এজাহারে মেয়েটি জানায়, জানুয়ারি মাসে ওই বাড়িতে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন গৃহকর্তা তৌহিদুল ইসলাম। ধর্ষণের ফলে সে এখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পুলিশ ওই গৃহকর্তাকে ৯ মে গ্রেপ্তার করে।
মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাকে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার কথা জানিয়েছে বাড্ডা থানার পুলিশ। তবে মেয়েটি বড় হয়েছিল রাজধানীর জুরাইন এলাকায়। সেখানকার এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। রুবিনা নামের ওই বাসিন্দা জানান, মেয়েটির মা–বাবা, ভাই–বোন, আত্মীয়স্বজন—কেউ নেই। এর–তার বাসায় বড় হয়েছে। তিনি ছোটবেলা থেকেই মেয়েটিকে দেখেছেন। কেউ নেই বলে মেয়েটিকে তাঁরা স্নেহের চোখে দেখতেন। জানুয়ারি মাসে তৌহিদুল ইসলামের স্ত্রী এসে মেয়েটিকে নিজ বাড়িতে রেখে লালন–পালন করার কথা বলে নিয়ে যান। মে মাসে তাঁরা জানতে পারেন, মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে। রুবিনা বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকেরা দ্যাইখেন, মেয়েটা যেন বিচার পায়। এতিম মেয়েটার জন্য অনেক মায়া লাগে। ওই লোকের বউ এসে সুন্দর কথা বলে ফুসলাইয়া নিয়ে গেল। যাঁর স্বামীর স্বভাব এত খারাপ, তাঁর বাসায় মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিল!’ মামলা–পরবর্তী সময়ে মেয়েটি কোথায় যাবে, তার ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেন তিনি।
>করোনা দুর্যোগে অনিশ্চয়তা আর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও নির্যাতন-নৃশংসতা চলছে মাত্রা ও ক্ষেত্রের হেরফের হলেও অপরাধ থামেনি
গত ২৮ মে বাবার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন এক তরুণী (১৮)। এজাহারে তিনি বলেন, তাঁর মা নেই। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। পরে বাবার কাছে আশ্রয় নেন। গত ডিসেম্বর মাস থেকে বাবা তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ধর্ষণ করছিলেন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদক আসাদুজ্জামানের নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩ জুন পর্যন্ত লকডাউনের মধ্যেও ঢাকা মহানগরে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৯৭টি মামলা হয়েছে। ধর্ষণসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৫৬টি ধর্ষণের, আটটি গণধর্ষণের, ধর্ষণচেষ্টার ১৪টি, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলা ৫১টি, অপহরণের মামলা ৩৬টি, শ্লীলতাহানির মামলা ১৮টি এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগের মামলা ৭টি।
অভিযোগ রয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সক্রিয় থাকার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার ব্যাপারে পুলিশের মনোযোগ কম। মাঠে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের মধ্যে ব্যাপক হারে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে, মারাও গেছেন অনেকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলায় আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের বিধান থাকলেও এ ব্যাপারে পুলিশের এখন ঢিলেঢালা ভাব। সাংবাদিক পারুল অভিযোগ করেছেন, তাঁর মামলা করার দেড় মাসেও আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ টালবাহানা করছে।
এ ব্যাপারে ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, লকডাউনে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ ছিল। মামলা দায়ের, আসামি গ্রেপ্তার, মামলায় প্রয়োজনীয় মেডিকেল পরীক্ষা করাতেও সমস্যা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য সরকারি–বেসরকারি ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র মার্চ মাস থেকে বন্ধ রাখা হয় সংক্রমণের ভয়ে।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে হতাশা প্রকাশ করে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বললেন, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এখন নির্যাতনের শিকার মেয়েদের পাশে প্রত্যেকের শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নারীর প্রতি মানসিক চিন্তা পরিবর্তন জরুরি। মানবিক মূল্যবোধ বিবেচনা করা জরুরি। নিজ নিজ এলাকার অপরাধীদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের একঘরে করতে হবে। অপরাধী যেন বাড়িতে, বাজারে, মসজিদে কোথাও স্থান না পায়। অপরাধীকে বোঝাতে হবে, এটাও তার জন্য একধরনের শাস্তি।
২৪ জুন আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন সাংবাদিক পারুল। প্ল্যাকার্ড হাতে পারুলের ক্রন্দনরত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে যায়, নাড়া দেয় বিবেকবান মানুষকে। পারুলেরা যেদিন তাঁদের বিচারের দাবি আদায় করে নিতে পারবেন, সেলিনা হোসেনের প্রত্যাশা যেদিন পূরণ হবে, নিশ্চিত সেদিন নেমেসিসের উপস্থিতি চেয়ে হৃদয়ে হাহাকার উঠবে না।