‘সুনাম নষ্ট করা ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি কথোপকথনের রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল করা’ এবং ‘মিথ্যা তথ্য প্রকাশের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চালানোর’ অভিযোগে দুই ছাত্রীর সিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল প্রশাসন। এর আগে কেন সিট বাতিল করা হবে না, জানতে চেয়ে দুজনকেই নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
ওই দুই ছাত্রী হলেন হল সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ও হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী দাস এবং স্বতন্ত্র জোটের নেত্রী শ্রবণা শফিক। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোকেয়া হলের কয়েকটি প্রশাসনিক পদে নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগটি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন শ্রবণা। আর হলের কর্মচারী শাহীন রানার সঙ্গে নিয়োগ–বাণিজ্যের বিষয়ে ফাল্গুনী দাসের একটি কথোপকথন ফাঁস হয়েছিল। তবে এই অভিযোগ তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা কমিটি নিয়োগ–বাণিজ্যের সত্যতা পায়নি।
১৫ জানুয়ারি ছাত্রী ফাল্গুনী, শ্রবণা ও কর্মচারী শাহীনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা। নোটিশে দুই ছাত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁদের সিট কেন বাতিল করা হবে না। শ্রবণার নোটিশটি তাঁর ইনস্টিটিউটের (ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউট) পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী ও অভিভাবককে পাঠানো হয়েছে। আর ফাল্গুনীকে দেওয়া নোটিশটির অনুলিপি তাঁর বিভাগে (কারুশিল্প) না পাঠিয়ে পাঠানো হয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনকে৷ কর্মচারী শাহীন রানার কাছেও তাঁর কথোপকথনের সত্যতার বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়। ইতিমধ্যে লিখিতভাবে নোটিশের জবাব দিয়েছেন ফাল্গুনী, শ্রবণা ও শাহীন।
রোকেয়া হলে নিরাপত্তাপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ কয়েকটি পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে হল সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) ইসরাত জাহান, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সায়মা প্রমি ও হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেত্রী তিন ব্যক্তির কাছ থেকে ২১ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে অভিযোগ করেছিলেন হলের কয়েকজন ছাত্রী। এর সঙ্গে হলের প্রাধ্যক্ষেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে ৩ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছিলেন তাঁরা। প্রমাণ হিসেবে কিছু অডিও রেকর্ডও ওই ছাত্রীরা সাংবাদিকদের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।
অভিযোগ তদন্তে ৫ সেপ্টেম্বর তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দীর্ঘ চার মাস তদন্ত শেষে ডিসেম্বরে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় কমিটি। তদন্তে নিয়োগ–বাণিজ্যের কোনো প্রমাণ মেলেনি। ২৯ ডিসেম্বরের সিন্ডিকেট সভায় উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন। প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবেদনে নিয়োগের নীতিমালা সংস্কারের অনুরোধ করেছিল কমিটি।
ছাত্রী শ্রবণা শফিক আজ শুক্রবার প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে হল প্রশাসন যে অভিযোগ করেছে, তা ‘অসত্য ও বেআইনি’। তাঁর দাবি, তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের ডাকা হয়নি। তিনি যে তথ্য দিয়েছিলেন, তা যে উৎস থেকে পাওয়া তা তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন৷ নিয়োগের আগের রাতে নিয়োগ–বাণিজ্যসংক্রান্ত ফোনালাপগুলো পেয়েছিলেন বলে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানোর সুযোগ ছিল না বলে ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলেন। প্রশাসন যে তদন্ত করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে এই ছাত্রী বলেন, তদন্ত কমিটি তাঁদের কোনো বক্তব্য নেয়নি।
আর ফাল্গুনী দাস বলেছেন, তাঁর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। তিনি মেধার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাই অন্যায়ভাবে তাঁর সিট বাতিলের অধিকার কারও নেই। যে ফোনালাপটি ফাঁস হয়েছিল, সেটি নিজের বলে স্বীকার করে এই ছাত্রী বললেন, হলে নিয়োগ–বাণিজ্যের অভিযোগ শোনার পর এর সত্যতা যাচাই করতে তিনি কর্মচারী শাহীনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তবে ফোনালাপ তিনি রেকর্ড করেননি বলেও দাবি করেন এই নেত্রী।
জানতে চাইলে রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো প্রমাণ ছাড়াই নিয়োগ–বাণিজ্যের মিথ্যা অভিযোগ তুলে অপপ্রচার করা হয়েছিল। তদন্তে তা উঠে এসেছে। তাই তাঁদের সিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাঁরা নোটিশের জবাব দিয়েছেন। এখন আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব, তাঁদের জবাব কতটা যৌক্তিক। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ফাল্গুনী ছাত্রলীগের নেত্রী হওয়ায় সংগঠনের চার নেতাকেও নোটিশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।’
আরও পড়ুন: