কামরাঙ্গীরচরের কালুনগর মৌজার ৫২ শতক একটি জায়গার মালিক এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেট। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই জমির মালিকানা দাবি করছে একটি পক্ষ। ইতিমধ্যে তারা জায়গাটি দখলে নিয়ে নিয়েছে। একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জায়গাটি বিক্রিও করেছে বলে অভিযোগ আছে।
এদিকে গত জুনে এই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ঢাকা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে ওয়াক্ফ প্রশাসন। কিন্তু এখন পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো হয়নি। কবে নাগাদ উচ্ছেদ শুরু হবে, তা–ও স্পষ্ট নয়।
এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই এলাকায় এক শতক জায়গার দাম প্রায় ২৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এই ৫২ শতক জায়গার দাম প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
ওয়াক্ফ প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৪৪ সালে হাজারীবাগ রোডে কালুনগর মৌজার ৫২ শতাংশ জমি এনায়েত বিবির নামে ওয়াক্ফ দলিলের মাধ্যমে ওয়াক্ফ লিল্লাহ করে দেন তাঁর স্বামী বোরহান মিয়া। এই জমির সিএ ও এসএ দাগ নম্বর ১৮৭, ওয়াক্ফ রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৪৩৪৮। দলিলে আবদুল বারেক সরদার, চাঁন মিয়া ও রবিউল্লাহ নামে তিনজনকে মোতোয়ালি নিযুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রবিউল্লাহ এনায়েত বিবির একমাত্র সন্তান। রবিউল্লার মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাঁর উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে জাল দলিল করে এই ওয়াক্ফ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করেন সলিমুল্লাহসহ ছয় ব্যক্তি। পরে জায়গাটি দখল করে তাঁরা প্লট তৈরি করেন এবং বিভিন্নজনের কাছে বিক্রিও করছেন।
ওয়াক্ফ দলিলে বর্ণিত শর্ত ছিল, কোনো মোতোয়ালি ওয়াক্ফ সম্পত্তি কোনো প্রকার হস্তান্তর, নিজের দেনার দায়ে কোনো প্রকার ক্রোক নিলাম, কায়েমি বন্দোবস্ত বা নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে না।
কালুনগর মৌজাটি ওয়াক্ফ প্রশাসনের অঞ্চল-১–এর আওতাধীন। এই অঞ্চলের পরিদর্শক রেজাউল করিম সরদার বলেন, ‘দলিল মোতাবেক এই জমিটির মালিক ওয়াক্ফ প্রশাসন। তাই এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতোয়ালি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ঢাকা জেলা প্রশাসনে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
ওয়াক্ফ এস্টেট জানায়, সিটি জরিপে জায়গাটি মৃত তিনজন মোতোয়ালিসহ অন্য কয়েকজনের নামে রেকর্ড হয়েছিল। পরে গত বছর ভূমি আপিল বোর্ডের মাধ্যমে তা সংশোধন করে ওয়াক্ফের নামে ফিরিয়ে আনা হয়। এ সময় এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে নামজারি ও ২০১৮ সাল পর্যন্ত সব খাজনা ওয়াক্ফ এস্টেটের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু এর আগেই তারা জায়গাটি দখল করে নেয়।
ওয়াক্ফ প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, নামজারি ও খাজনা জমা দেওয়ার পর জায়গাটি দখলে নিতে গত জানুয়ারিতে ওয়াক্ফ প্রশাসনে আবেদন করে এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেট পরিচালনা কমিটি। পরে বিষয়টি তদন্ত করে এবং দখলকারীদের কাছে তাদের দাবির সমর্থনে দলিলপত্র চায় ওয়াক্ফ প্রশাসন। এ জন্য শুনানির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বারবার তারিখ নেওয়ার পরও তেমন কোনো কাগজপত্র দিতে পারেনি। তাই গত জুনে তাদের উচ্ছেদের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসনে আবেদন পাঠিয়েছে ওয়াক্ফ প্রশাসন। এখন পর্যন্ত তাদের উচ্ছেদ করা হয়নি।
তবে ভিন্ন কথা বলছেন এই জমির অন্যতম দাবিদার সলিমুল্লাহ। তিনি বলেন ‘৭০ বছর আগে আমরা এই জমির মালিক হয়েছি। এখানে ওয়াক্ফ জমি নেই। কিন্তু আমাদের অজান্তে ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করে একটি পক্ষ। পরে আমরা জানতে পারি, এই রায় ওয়াক্ফের পক্ষে গেছে। এর কিছুদিন পর ভূমি আপিল বোর্ডে রিভিউ মামলা করেছি। এই রিভিউ মামলা এখনো চলমান আছে।’ এ সময় সলিমুল্লার কাছে তাঁর দাবির পক্ষে সব কাগজপত্র চাওয়া হয়। দু-এক দিনের মধ্যে সব কাগজপত্র তিনি দেবেন বলে সময় নির্ধারণ করেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তিনি কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তাঁর মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়।
এনায়েত বিবি ওয়াক্ফ এস্টেটের পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও হাজারীবাগের নিলাম্বর সাহা রোডের বাসিন্দা শাহ্ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই জমির আয়ের অর্থ হাজারীবাগ বড় মসজিদের উন্নয়ন ও মুসল্লিদের জন্য ব্যবহার করার কথা। কিন্তু জমিটি আজ পর্যন্ত অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারেনি ওয়াক্ফ প্রশাসন। সে জায়গায় এখন নামে-বেনামে ঝুলছে মালিকানার সাইনবোর্ড। তিনি বলেন, সলিমুল্লাহর বিলম্বিত রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তিনি নির্দিষ্ট সময়ের সাত মাস পর ভূমি আপিল বোর্ডে রিভিউ মামলা করেছেন। তা ছাড়া, রিভিউ মামলায় ওয়াক্ফ প্রশাসনকে পক্ষ করা হয়নি। তাই অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদে আইনগত বাধা নেই।
গত ১৮ নভেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, সদরঘাট-গাবতলী বেড়িবাঁধ সড়কের পশ্চিম পাশে কালুনগরের ওই দাগের চারপাশে প্রায় সাত ফুট উঁচু করে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ভেতর তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন প্লট। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ড ঝুলছে। জমির মালিক বা নিরাপত্তাকর্মীদের কাউকে দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) ইলিয়াস মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। কিন্তু এর মধ্যে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনায় স্থগিতাদেশ দেন আদালত। তাই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি।’