অর্থ পাচার আইনে গত ২৩ ডিসেম্বর এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর স্ত্রীসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সিআইডি মামলা করেছে।
পিরোজপুরের এহসান গ্রুপ গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া ১০১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছে বলে উঠে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে। সুদের বদলে প্রতি এক লাখ টাকায় দুই হাজার টাকা ‘মুনাফা’ দেওয়ার কথা বলে ‘অবৈধভাবে’ আমানত হিসেবে এই টাকা নিয়েছিল গ্রুপটি।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকা থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ’ নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর সহযোগী আবুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একই দিন বিকেলে পিরোজপুর সদর থানার পুলিশ রাগীব আহসানের দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খাইরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। আসামিরা এখন কারাগারে।
ওই সময় র্যাব দাবি করেছিল, এহসান গ্রুপ গ্রাহকদের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। প্রতারণা ও জালিয়াতি করে তারা বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানের পর গ্রাহকদের ১০১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। সরিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
উল্লেখ্য, টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনার অনুসন্ধান শেষে গত ২৩ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদর থানায় অর্থ পাচার আইনে মামলা করেছে সিআইডি। মামলার বাদী সিআইডির পরিদর্শক মীর কাশেম। মামলায় এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান, তাঁর স্ত্রী সালমা আহসান, আবুল বাশার খান, খায়রুল ইসলাম, শামীম হাসান, মাহমুদুল হাসান, নাজমুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে তাঁদের আসামি করা হয়। এর বাইরে আরও সাত থেকে আটজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
সিআইডি বলছে, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের নামে গ্রুপটি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেছে। ২০০৮ সাল থেকে দুই প্রতিষ্ঠানের নামে পিরোজপুর, বাগেরহাট ও ঝালকাঠি জেলার হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এই টাকা তোলা হয়। এ জন্য অবৈধভাবে জমা পাস বই ও আমানত গ্রহণের রশিদ ব্যবহার করা হতো। তবে কোম্পানির নিবন্ধন (রেজিস্ট্রার) খাতার তথ্য অনুযায়ী তাঁদের সদস্য রয়েছে ৪২৭ জন।
অনুসন্ধানের পর গ্রাহকদের ১০১ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। সরিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।হুমায়ুন কবির, বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি
গ্রাহকের টাকা নিয়ে এহসান গ্রুপ কী করেছে, তা–ও উঠে এসেছে সিআইডির অনুসন্ধানে। সূত্র বলছে, এহসান গ্রুপ গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিয়ে নূর-ই-মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, নূর জাহান মহিলা মাদ্রাসা, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, আল্লারদান বস্ত্রালয়, মক্কা এন্টারপ্রাইজ, বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স, সাহাবা হজ কাফেলা ও এহসান সাউন্ড সিস্টেম—এই ৯টি প্রতিষ্ঠান খুলে সেখানে বিনিয়োগ করে। পাশাপাশি গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব আহসান ও তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নামে জমি কেনা হয়।
রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস ও ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত খুলনার একটি মাদ্রাসায় ইসলামি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন।
২০০৮ সালে রাগীব আহসান পিরোজপুরে সমবায় অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি সমবায় সমিতি খুলে আমানত নেওয়া শুরু করেন। এর এক বছর আগে তিনি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির কাছে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার লাইসেন্সের আবেদন করেছিলেন। তবে তিনি তা পাননি।
সিআইডি সূত্র বলছে, অবৈধভাবে আমানত গ্রহণ করায় ২০১২ সালের মে মাসে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এহসান গ্রুপকে গ্রাহকের সঞ্চয় ফেরত দিতে বলেছিল। ২০১১ সালে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলে রাগীব আহসান তাঁর স্ত্রী সালমা আহসানকে চেয়ারম্যান করেন।
গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, এহসান গ্রুপ ৫৪ মাস, ৫৬ মাস, ৬ বছর, ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করত। বাড়তি মুনাফার আশায় সাধারণ মানুষ টাকা জমা রাখতে আগ্রহী হয়েছিলেন। শুরুতে কয়েক মাস গ্রাহকদের ‘মুনাফা’ বাবদ টাকা দিত এহসান গ্রুপ। পরে আর কোনো টাকাই দেয়নি তারা। গ্রাহকের টাকা দিয়েই আরও ৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন রাগীব আহসান।
সিআইডি সূত্র বলছে, এলাকায় ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশগ্রহণকারীদের আমানত রাখতে আকৃষ্ট করত এহসান গ্রুপ।