বুড়িগঙ্গার তীরে বেড়ানো শেষে বাসায় ফেরার পথে খুন হয় সিফাত (১২)। সিফাতের মৃত্যুর ঘটনায় তার নানা আজগর আলী ছয় শিশুর নাম উল্লেখ করে কামরাঙ্গীরচর থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ অভিযুক্ত ছয় শিশুকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠায়। মামলার নথিপত্র বলছে, সিফাত খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার ৬ শিশুর মধ্যে ১০ বছর বয়সী শিশু আছে দুজন। বাকি ৪ জনের বয়সও মাত্র ১২।
জানা গেছে, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে ১২ বছর বয়সী এক শিশুর পা মাড়িয়ে দেয় সিফাত। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে শিশুটি তার সঙ্গীদের নিয়ে সিফাতকে ধাওয়া করে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিফাতের মৃত্যু হয়।
গত রোববার গ্রেপ্তার হওয়া ছয় শিশু সিফাত হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সবাই এখন টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে আছে।
সিফাত হত্যায় জড়িত শিশুদের ব্যাপারে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনে এত কম বয়সী শিশুদের হত্যায় জড়িত থাকার ঘটনা পাইনি। সিফাত হত্যায় জড়িত সব শিশুর বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এত কম বয়সী শিশুদের খুনের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক।’
সিফাতের পরিবারের সূত্রমতে, মাত্র তিন মাস বয়সেই তার মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে মায়ের কাছেই বড় হচ্ছিল সে। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে নানাই তাকে বড় করে তুলছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামরাঙ্গীরচর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সিফাত হত্যা মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে যে ‘কিশোর গ্যাং’র সন্ধান পেয়েছেন, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১০ থেকে ১২ বছর। পা মাড়িয়ে দেওয়ার মতো সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৃশংসভাবে সিফাতকে হত্যা করেছে আইনের সংস্পর্শে আসা এসব শিশুরা। তিনি জানান, দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৯ বছর বয়সের নিচের কোনো শিশুকে আসামি করা যায় না।
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এবং মামলার নথিপত্রের তথ্যমতে, সিফাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যে শিশুটি জড়িত, তার বয়স ১২ বছর। সে তার মা–বাবার সঙ্গে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় থাকে। এই শিশুটি ধারালো চাকু দিয়ে সিফাতের তলপেটে আঘাত করে। খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার অন্য পাঁচ শিশুও কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দা। তাদের তিনজন বিদ্যালয়ে যায়, দুজন কারখানায় কাজ করে।
কামরাঙ্গীরচর থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিফাত হত্যার তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী আদালতে গিয়ে সাক্ষী হিসেবে ঢাকার সিএমএম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের বয়সও ১০ থেকে ১৪ বছর।
সিফাতের নানা আজগর আলী অভিযোগ করে বলেন, যে শিশু-কিশোরেরা তাঁর নাতিকে হত্যা করতে দেখেছে, যারা আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের এখন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আটক শিশু-কিশোরদের পরিবারের সদস্যরা সাক্ষীদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সিফাত হত্যা মামলায় যে তিন শিশু-কিশোর আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে, তাদের কেউ হুমকি দিয়ে পার পাবে না। ইতিমধ্যে বিষয়টি তাঁর নজরে এসেছে। ওই তিন সাক্ষী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বলা হয়েছে, কেউ যদি হুমকি দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন থানাকে জানানো হয়।
এদিকে সিফাতের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তার নানা বৃদ্ধ আজগর আলী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় একটি কার্টনের কারখানায় কাজ করত সিফাত। মাস শেষে যে টাকা পেত, সেটা তাঁর হাতেই তুলে দিত। কোনো দলের সঙ্গে সে মিশত না, কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া করত না সিফাত।
সিফাত খুনের খবর পাওয়ার পর পাগলপ্রায় তার মা রাশিদা খাতুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরাকে ওরা বিনা দোষে খুন করে ফেলল। আমি বিচার চাই। আমার ছেলের মতো পরিণতি আর কারও যেন না হয়।’