>• জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা।
• হামলাকারী ফয়জুরকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ।
• ফয়জুর নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতেন।
• প্রতিবাদ চলছে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর রহমান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত নন, নিজে নিজেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। জাফর ইকবালকে হত্যার লক্ষ্যে এক বছর ধরে তক্কে তক্কে ছিলেন। তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফয়জুর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, জাফর ইকবাল কখন, কোথায় যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে তিনি খোঁজ রাখছেন এক বছর ধরে। তবে খোঁজ রাখার কাজে কারও সহযোগিতা নিয়েছেন কি না, সে প্রশ্ন করলেই চুপ করে থাকছেন ফয়জুর। তাঁর শারীরিক অবস্থার কারণে এখন খুব জোরালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করা যাচ্ছে না।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, জাফর ইকবাল যে ওই দিন ওই সময়ে এমন একটি অনুষ্ঠানে থাকবেন, ভেতরের সহযোগিতা ছাড়া ফয়জুরের পক্ষে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার বেলা তিনটা থেকে শুরু হওয়া ‘রোবো কমব্যাট’ প্রতিযোগিতায় জাফর ইকবালের থাকার সিদ্ধান্ত পূর্বনির্ধারিত ছিল না। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুদিনব্যাপী ‘সাস্ট ট্রিপল ই ফেস্টিভ্যাল ২০১৮’-এর সকাল ও সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে তিনি থাকবেন এমনটাই জানিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী তিনি শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে পৌঁছান। দুপুরের খাবারের বিরতির পর তিনি বেলা তিনটায় মুক্তমঞ্চে অতিথিদের জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসেন।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখেছে, ওই দিন ফয়জুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে সকাল ৯টার দিকে সাইকেলে করে ঢুকছেন। এরপর সাত মিনিট পর্যন্ত তাঁকে দেখা গেছে। সাত মিনিটের মাথায় তাঁর অবস্থান ছিল প্রধান ফটক থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনা একাত্তর ভাস্কর্যের কাছে। বেলা তিনটার পর ফয়জুরকে দেখা গেছে মুক্তমঞ্চে মুহম্মদ জাফর ইকবালের পেছনে। মাঝের সময়টায় ফয়জুর কোথায় ছিলেন, সেটা জানা যায়নি। চেতনা একাত্তর থেকে মুক্তমঞ্চের দূরত্ব আনুমানিক দেড় শ গজ। মাঝখানে একটি সিসি ক্যামেরা সেদিন অচল ছিল।
তবে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফয়জুর পুলিশকে বলেছেন, তিনি ওই দিন দুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন। সেটা কখন কখন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে এক যুবকের ছবি দিয়ে খোঁজ নেওয়ার অনুরোধ করেছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাস তিনেক আগে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনের দেয়ালে ক্লাস রুটিন টাঙানো থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই তাঁর দিনলিপি সম্পর্কে মোটামুটি ওয়াকিবহাল।
প্রশ্ন উঠেছে ঘটনার দিন ফয়জুরের পোশাক নিয়েও। ফয়জুরের পরনে কালো টি-শার্ট ও ছাইরঙা জিনস ছিল। উৎসবে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের গায়েও একই রঙের টি-শার্ট ছিল। ওই উৎসবে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং, নর্থ ইস্ট ও মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ছিলেন। সবার গায়ে একই রঙের টি-শার্ট ছিল। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের আলাদা পরিচয়পত্র ছিল না। ফলে ফয়জুরকে দেখে কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা কী ধরনের পোশাক পরবেন, সেটা ফয়জুরের মতো বাইরের মানুষ কীভাবে জানলেন? এ প্রশ্নের জবাবে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘খবরাখবর দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে লোকের অভাব নেই।’
উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত ২১ জানুয়ারি প্রথম আলোতে এখানকার ১১ ছাত্রের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে জড়িত থাকার ওপর খবর ছাপা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দীন আহমেদ গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপর তারা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
ফয়জুরের সাইকেলটি কোথায়
সিসি ক্যামেরায় ফয়জুরকে সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেখা গেছে। তাঁর পকেট থেকে সাইকেলের চাবি পাওয়া গেছে। কিন্তু সাইকেলটি এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি পুলিশ।
তা ছাড়া ফয়জুরকে সারাক্ষণ প্রতিবেশীরা মুঠোফোনে কথা বলতে দেখলেও ঘটনার দিন তাঁর সঙ্গে ফোন ছিল না। গণপিটুনির শিকার হওয়ার পর শিক্ষকেরা ফয়জুরকে নিজেদের জিম্মায় নেন। তাঁরা ফয়জুরের পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা ছুরি (ভাঁজ খুললে আনুমানিক ছয় ইঞ্চি), চিড়া, সাইকেলের চাবি ও ১০ টাকা পান।
একজন আটক, ফয়জুরের ভাই পলাতক
সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টায় জড়িত আরও একজনকে আটক করা হয়েছে। এ নিয়ে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তিনজনকে।
ফয়জুরের বাবা আতিকুর রহমান ও মা মিনারা বেগম রোববার রাতে আত্মসমর্পণ করলেও তাঁর ভাইবোনকে খুঁজে পায়নি পুলিশ। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ফয়জুরের বাবা-মা তাদের কিছু তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
প্রতিবাদ চলছে
মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে গতকালও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল, প্রতীকী অবস্থান, কর্মবিরতি ও পথনাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে মৌন মিছিলের আয়োজন করে শিক্ষক সমিতি।