দুজনেরই বয়স ১০ বছর। মা–বাবা নেই। বাড়ি কোথায়, তা–ও জানে না। ৭ বছর বয়সে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামে আসে। তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন ও উড়ালসড়কই তাদের ঠিকানা। শুরুতে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করত। সেই টাকায় নেশা। পরে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশার টাকা জোগাড়ে জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইয়ে। ছয় মাস ধরে উড়ালসড়কে ছিনতাই করে আসছে তারা।
এই দুজনের মতোই চট্টগ্রামের উড়ালসড়কে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েছে একটি ‘কিশোর গ্যাং’। গত ২৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আট দিনে নগরের উড়ালসড়কের আশপাশে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-পুলিশ, যাদের বেশির ভাগই শিশু-কিশোর। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরি, রড ও সুতা পাওয়া গেছে।
পুলিশের উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার কয়েকজন কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ থেকে ছয়জনের দলে ভাগ হয়ে তারা ছিনতাই করে। মূলত নেশার টাকা জোগাড়ের জন্যই তাদের ছিনতাইয়ে নামা। তারা ‘ড্যান্ডি’ সেবন করে। একটি ছেলে জানাল, কৌতূহলবশত নিতে গিয়ে এখন আর ছাড়তে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ড্যান্ডি হলো একধরনের আঠা। ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, চামড়া ও প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে এই আঠা ব্যবহৃত হয়। এটা ঘ্রাণযুক্ত এবং ঘ্রাণ থেকেই একধরনের আসক্তি তৈরি হয়।
>৮ দিনে ৪৪ জন গ্রেপ্তার
বেশির ভাগই শিশু-কিশোর
নেশার টাকা জোগাড়ে ছিনতাই
ড্যান্ডির প্রতিটি টিউবের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, কৌটার দাম ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। দাম বেশি হওয়ায় আসক্ত কিশোরেরা সাধারণত কৌটা কিংবা টিউব কেনে না। পেশাদার মাদকসেবীদের কাছ থেকে তারা খুচরা কিনে নেয়। একেকজনের দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ টাকার মতো ড্যান্ডি লাগে।
গ্রেপ্তার কিশোরেরা জানাল, এই আঠা প্রথমে তারা পলিথিনের ভেতরে ঢোকায়। এরপর পলিথিন থেকে এর ঘ্রাণ মুখ ও নাক দিয়ে টেনে নেয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলালউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ড্যান্ডি সেবনে শিশু-কিশোরদের আবেগ, চিন্তা ও আচরণে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক পরিবর্তন আসে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হতাশা ভুলতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু-কিশোরেরা এটি সেবন করে। অপরাধীর চোখে না দেখে এসব শিশুর পুনর্বাসন খুব জরুরি।
সোহেল (ছদ্মনাম) নামের এক কিশোরের মা জানালেন, বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী তাকে ফেলে চলে যান। মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। ইতিমধ্যে তিনি বিয়ে করেন। এতে নারাজ হয়ে সোহেল তাকে ছেড়ে চলে যায়। ফুটপাতে অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকে। বেশ কয়েকবার আনতে গেলেও রাজি হয়নি।
গত ২৫ জুলাই প্রথম আলোর শেষ পাতায় ‘উড়ালসড়কে রশি বেঁধে ছিনতাই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ফেব্রুয়ারির পর গত ছয় মাসে ৫০টি মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারীদের বেশির ভাগই কিশোর। আর নেশার টাকার জন্য তারা ছিনতাই করছে। প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই র্যাব-পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনার তদন্তে নামে।
নগরের আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কে রশি বেঁধে ছিনতাইয়ে জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের ছয়জনকে গত ২৮ জুলাই গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা উড়ালসড়কে রশি বেঁধে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত।
বর্তমানে নগরের আকবর শাহ থানা-পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। আকবর শাহ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মূলত নেশার টাকার জন্য ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে কিশোরেরা। তারা চুরিও করছে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অভিভাবকহীন কিশোরেরা ফুটপাত ও উড়ালসড়কে আস্তানা করেছে। তারা ড্যান্ডি সেবন করতে মানুষের কাছ থেকে মুঠোফোন ছিনতাই করে, ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নেয়। আবার কখনো কাদা ছুড়ে মারে। গ্রেপ্তার কিশোরদের গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র ও হাটহাজারীর শেখ রাসেল পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রের উপপ্রকল্প পরিচালক জেসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রে কিশোরদের কাউন্সেলিংসহ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুন্ডু মনে করেন, একটি শিশুরও যেন ঘর ছেড়ে ফুটপাতে থাকতে না হয়, সেই চেষ্টাই করতে হবে। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটির, পরিবারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তবে এসব শিশু–কিশোরকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে সম্পদে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।