এক হাজার ইয়াবা উদ্ধারের মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তিনি নিজের নাম–ঠিকানা গোপন রেখে অন্যের ঠিকানা দেন। পুলিশ তা যাচাই করে দেখেনি। পরে তাঁকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। তদন্ত শেষে প্রকৃত আসামির পরিবর্তে অন্য ব্যক্তির নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। অথচ গ্রেপ্তারের এক বছর পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। হয়ে যান পলাতক। তদন্তে পুলিশের গাফিলতির কারণেই এমনটি হয়েছে।
ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামির পরিবর্তে কক্সবাজারের চকরিয়ার এক ব্যক্তির নামে পরোয়ানা গেলে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়। ওই ব্যক্তিকে অব্যাহতি দিয়ে প্রকৃত আসামিকে ৮ সেপ্টেম্বর শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এক আসামি আরেকজনের নাম–ঠিকানা যাতে ব্যবহার করতে না পারেন, দেশের থানা ও কারাগারে আসামির তথ্য সংরক্ষণে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন। চকরিয়ার সালাউদ্দিনের মতো আসামি না হয়েও ঘটনার শিকার হয়েছিলেন নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মোহাম্মদ জহির উদ্দিন। তাঁর ঠিকানায় পরোয়ানা গেলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর নগরের কালুরঘাট ব্রিজ–সংলগ্ন এলাকা থেকে এক হাজার ইয়াবাসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও থানা-পুলিশ। এ ঘটনায় ওই থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে আসামি করা হয় কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার কুটাখালী এলাকার মমতাজ আহমদের ছেলে মো. সালাউদ্দিনকে।
পরে মামলাটি তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৮ নভেম্বর আদালতে সালাউদ্দিনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন চান্দগাঁও থানার এসআই এ এফ এম জিয়াউল হুদা। বর্তমানে তিনি ঢাকা পুলিশে বিশেষ শাখায় কর্মরত। সঠিকভাবে আসামির নাম-ঠিকানা যাচাই না করে কেন অভিযোগপত্র দিয়েছেন জানতে চাইলে মুঠোফোনে এসআই এ এফ এম জিয়াউল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদক মামলায় আসামি গ্রেপ্তার থাকায় ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিয়ে দিতে হয়। ইএস স্লিপ না পাওয়ায় তাই প্রতিবেদন জমা দিয়ে দিয়েছি। পরে আদালতের মাধ্যমে জানতে পারলাম, ওই ঠিকানা ভুয়া।’
এদিকে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে যান ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া আসামি। পলাতক হওয়ায় আদালত আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এ বছরের আগস্ট মাসে চকরিয়া থানায় গেলে এক পরিচিতজনের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন সালাউদ্দিন। পেশায় কৃষক সালাউদ্দিন ও তাঁর পরিবার বিষয়টি জানতে পেরে অবাক।
ইয়াবা উদ্ধারের মামলাটির বিষয়ে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঞার আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সালাউদ্দিনের আইনজীবী সুহার্ত খাস্তগীর ৮ সেপ্টেম্বর আদালতে লিখিত আবেদন করেন। সেখানে বলা হয়, সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তিনি কখনো গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাননি। ওই আদালতে হাজির ছিলেন সালাউদ্দিনও।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, আদালত তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ককে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। তাঁরা কারা নিবন্ধনে থাকা ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার আসামির ছবি ও তথ্য পাঠান আদালতে। আদালত ওই ছবির সঙ্গে পরোয়ানা যাওয়া সালাউদ্দিনের চেহারার মিল পাননি। পরে চকরিয়ার সালাউদ্দিনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন পুলিশকে।
সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি সুরাহা না করলে আসামি না হয়েও তাঁকে কারাগারে কাটাতে হতো।
কেন সালাউদ্দিনের নাম বললেন আসামি—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সালাউদ্দিনের জমিতে কাজ করার জন্য কয়েকজন কৃষিশ্রমিককে তাঁর বাড়িতে আনেন। ওই সময় রোহিঙ্গা এক শ্রমিকের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। এ ঘটনার জেরে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে ওই রোহিঙ্গা তাঁর নাম বলতে পারেন।
কারাগারের রেজিস্টারে থাকা একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি আছে শুধু আসামির। তাঁকে শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তারের জন্য আর কোনো তথ্য নেই। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের পর থানায় ও কারাগারে তাঁর ছবি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ থাকলে সহজেই গ্রেপ্তার করা যেত। তদন্ত কর্মকর্তা যথাযথভাবে তদন্ত করলে আসামি কারাগারে থাকাকালীন পরিচয় গোপনের বিষয়টি ধরা পড়ত।