ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীনকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে টাকা ও গয়নাগাটি লুট করেছিলেন দুই গৃহকর্মী। দুজনই কাজে যোগ দেওয়ার সময় ভুয়া ঠিকানা দিয়েছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, হত্যার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং গৃহকর্মীদের বাইরেও এর সঙ্গে অন্য কোনো চক্র জড়িত থাকতে পারে।
মাহফুজা চৌধুরী গত রোববার বিকেলে নিজের বাসায় খুন হন। তিনি এলিফ্যান্ট রোডের সুকন্যা টাওয়ারের একটি বাসায় থাকতেন। ডুপ্লেক্স বাসাটির দোতলায় নিজেরা আর নিচতলায় তিনজন স্থায়ী ও একজন অস্থায়ী গৃহকর্মী থাকতেন। ঘটনার সময় বাসায় তিনজন স্থায়ী গৃহকর্মী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে স্বপ্না (৩৫) ও রেশমা (৩০) নামের দুজন পালিয়ে যান। স্বপ্না ২ ফেব্রুয়ারি ও রেশমা মাস দেড়েক আগে এ বাসায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। অন্য গৃহকর্মী আরও আগে থেকেই এখানে কাজ করতেন এবং ঘটনার সময় তিনি নিচতলায় ছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।
পলাতক দুই গৃহকর্মী এবং তাঁদের সরবরাহকারী রুনুকে আসামি করে মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী ইসমত কাদির গামা ঘটনার পরদিন সোমবার নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করেন। এঁদের মধ্যে আজ শুক্রবার নেত্রকোনার মদন থেকে স্বপ্নাকে এবং ঢাকার মিরপুর থেকে রুনুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রেশমা এখনো পলাতক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাটি পরিকল্পিত হতে পারে এবং এর সঙ্গে কোনো চক্র জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, কোনো গৃহকর্মীই ওই বাসায় মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারতেন না। মুঠোফোনটি মাহফুজার কাছে জমা রাখতে হতো। ২ ফেব্রুয়ারি স্বপ্না কাজে যোগ দেওয়ার সময় তাঁর নিজের মুঠোফোনটি জমা দেননি। অন্য একটি মুঠোফোন জমা দিলেও তাতে সিম ছিল না। সিমটি তিনি অস্থায়ী গৃহকর্মীকে দিয়ে দেন। অস্থায়ী গৃহকর্মী স্বপ্নার সিমটি ব্যবহার করায় তদন্ত কর্মকর্তারা ‘ডিজিটাল ডাটা অ্যানালাইসিস’ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হন।
কর্মকর্তারা মনে করছেন, নিজের সিমটি অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া স্বপ্নার পরিকল্পনার অংশ। তবে এ বিষয়ে তাঁরা এখনো নিশ্চিত নন। এ ছাড়া তাঁদের যে ভুয়া ঠিকানা মাহফুজা চৌধুরীর ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল, তা ছিঁড়ে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এটিকেও একটি ‘সুচিন্তিত’ পরিকল্পনা বলে মনে করছে পুলিশ।
ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় প্রতিটি তদন্ত সংস্থাই আসামিদের গ্রেপ্তারে কাজ শুরু করে। পুলিশের তদন্তের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সাজ্জাদ ইবনে রায়হান। ঘটনার পর থেকে পুলিশের তিনটি টিম ঢাকা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ফরিদপুরে অভিযান চালায়।
এই দুজনের গ্রেপ্তারের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার আজ শুক্রবার বিকেলে নিউমার্কেট থানায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, স্বপ্না ও রেশমার ছবি মাহফুজা চৌধুরীর মুঠোফোনে ছিল। তাঁদের ঠিকানা লেখা ছিল মাহফুজার ডায়েরিতে। হত্যার পর মুঠোফোন ও ডায়েরির পাতা দুটিই তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে যান। এ কারণে অন্য গৃহকর্মী রেশমার কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বাড়িতে কোনো গৃহকর্মী নিয়োগ দিলে তাঁর নাম, পরিচয় ও ঠিকানা লিখে রাখাতে নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে মারুফ হোসেন বলেন, এগুলো যাচাই-বাছাই করে পরিবারের একাধিক ব্যক্তির কাছে রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানায়ও তথ্যগুলো সরবরাহ করতে হবে। এতে কেউ যদি অপরাধ করে, তবে তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাহফুজাকে খুনের পর দুই গৃহকর্মী ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচের তলার দরজা দিয়ে বের হন। এরপর লিফটে করে নিচে নেমে বেরিয়ে যান। গ্রেপ্তার স্বপ্না পুলিশকে জানিয়েছেন, বাসা থেকে বেরিয়ে তাঁরা দুজন সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে আসেন। তিনি একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে গাবতলী চলে যান। আর রিকশায় করে রওনা হন রেশমা। তবে রেশমা কোথায় যাচ্ছেন, তা তাকে জানাননি বলে স্বপ্না দাবি করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, খুনের ঘটনার পরপরই মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী ইসমত কাদির গামা গৃহকর্মী সরবরাহকারী রুনুকে মুঠোফোনে কল দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রুনু মোহাম্মদপুরে থাকতেন। কিন্তু তিনি না এসে সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোন বন্ধ করে দেন। এরপর রুনুর মুঠোফোনের কললিস্ট থেকে পাওয়া এক গৃহকর্মীর সঙ্গে পুলিশ যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, রুনু তাঁকে মিরপুর গিয়ে দেখা করতে বলেছেন। পুলিশ ওই গৃহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুরে গিয়ে রুনুকে গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, স্বপ্নাকে রুনুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আনোয়ার নামে এক ব্যক্তি। তার কাছ থেকে স্বপ্নার বাড়ির আসল ঠিকানা নেত্রকোনার মদনপুর বলে জানা যায়। পরে সেখান থেকে স্বপ্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাহফুজার বাসা থেকে খোয়া যাওয়া নগদ সাত হাজার টাকা এবং এক থেকে দেড় ভরি ওজনের একটি সোনার চেন স্বপ্নার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী ইসমত কাদির গামা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। মাহফুজা চৌধুরী ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সুকন্যা টাওয়ারের ১৫ ও ১৬ তলায় দুটি ফ্ল্যাটে (ডুপ্লেক্স) এই দম্পতির বহুদিনের সংসার। ওপরের অংশটিতে তাঁরা থাকেন। নিচতলায় রান্নাঘর, গৃহকর্মীদের আবাস। তাঁদের দুই ছেলের একজন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক, আরেকজন ব্যাংকে চাকরি করেন বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা।