আশুলিয়া সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

  • জমির দাম দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৭ হাজার টাকা
  • রাজস্ব আদায় হয়েছে ২০ লাখ ৯০ হাজার ৫৩৯ টাকা
  • রাজস্ব হওয়ার কথা ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯১৪ টাকা


ঢাকার আশুলিয়া সাব–রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে ১৮টি সাফ কবলা দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৫ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এসব দলিল ঘেঁটে রাজস্ব ফাঁকির সত্যতা পাওয়া যায়।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে নিবন্ধিত ১৮টি দলিলের নকলের জন্য আশুলিয়া সাব–রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে আবেদন করা হয়। এরপর সেই কার্যালয় থেকে নকল সরবরাহ করা হয়। এসব দলিলে উল্লেখ করা জমির শ্রেণির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আশুলিয়া রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তথ্য চেয়ে আবেদন করা হয়। তথ্য অধিকার আইনে এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তথ্য সরবরাহ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্য ও দলিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ সালে ১৭টি দলিলে শ্রেণি পরিবর্তন করে প্রায় চার একর জমি নিবন্ধন করা হয়েছে। এসব জমির দাম দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। এতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২০ লাখ ৯০ হাজার ৫৩৯ টাকা। অথচ প্রকৃত শ্রেণি অনুযায়ী সরকারি হিসাবে এসব জমির মূল্য দাঁড়ায় ১২ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার ১২৮ টাকা, যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হতো ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯১৪ টাকা। এতে ৮৭ লাখ ৯৪ হাজার ৩৭৫ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি দলিলে অনিয়মের মাধ্যমে ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালের ৭ আগস্ট নিবন্ধিত ১০৭৩৩ নম্বর দলিলে আশুলিয়ার ধামসোনা মৌজায় ১৬ শতাংশ জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে পতিত। তবে আশুলিয়া রাজস্ব সার্কেল থেকে সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী ওই জমি টেক ও চালা শ্রেণির। টেক শ্রেণির ১ শতাংশ জমির নির্ধারিত মূল্য ছিল ৪ লাখ টাকা। চালা শ্রেণির ১ শতাংশ জমির মূল্য ২ লাখ টাকা। পতিত শ্রেণির প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ১০ হাজার ৬৭ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী টেক ও চালা শ্রেণির ১৬ শতাংশ জমির গড় রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। কিন্তু পতিত শ্রেণি দেখিয়ে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

আশুলিয়ার ধনঞ্জয়পুর মৌজা থেকে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট নিবন্ধিত ১০৮৫৮ নম্বর দলিলে ৫৭ শতাংশ জমি হেবামূলে দান দেখানো হয়। দলিলে জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে জঙ্গল। কিন্তু আশুলিয়ার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী এই জমি বাঁশঝাড়, বাড়ি ও চালা শ্রেণির। সাব–রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে এই মৌজায় জঙ্গল শ্রেণির ১ শতাংশ জমির মূল্য ছিল ৪২ হাজার ৬০৪ টাকা। আর বাঁশঝাড় শ্রেণির প্রতি শতাংশ জমির দাম ২ লাখ ৭৫ হাজার, বাড়ি শ্রেণির ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৭ ও চালা শ্রেণির ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৩৩ টাকা ছিল। এসব শ্রেণির ৫৭ শতাংশ জমির গড় রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। জঙ্গল শ্রেণি দেখিয়ে আদায় করা হয়েছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩২০ টাকা। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮০ টাকা।

একই মৌজায় ১০৬৪০ নম্বর দলিলে ৫৮ শতাংশ জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ১০ লাখ ৭৮ হাজার ২৪০ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট নিবন্ধিত ওই দলিলে জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে জঙ্গল। অথচ আশুলিয়ার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ওই জমি বাঁশঝাড়, বাড়ি ও চালা শ্রেণির। শ্রেণি পরিবর্তন করে একই বছর একই মৌজার ১০৮৫৭ নম্বর দলিলে ১০ লাখ ৭৮ হাজার ২৪০ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ওই দলিলে বাঁশঝাড়, বাড়ি ও চালার পরিবর্তে জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে জঙ্গল।

একইভাবে ১০৬৪১ নম্বর দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এই দলিলে জমির শ্রেণি দেখানো হয়েছে জঙ্গল। সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ওই জমি বাঁশঝাড়, বাড়ি ও চালা শ্রেণির।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাকি ১২টি দলিলে একইভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৪০ লাখ ১৬ হাজার ২১৫ টাকা। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই নিবন্ধিত ১০১৬৫ নম্বর দলিলের মাধ্যমে একটি বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান ৫ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার টাকায় ১ একর ২০ শতাংশ জমি বিক্রি করে। জেলা নিবন্ধকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে জমি সাব–কবলা করে দিলে আশুলিয়া এলাকার জন্য শতকরা ১২ টাকা হারে রাজস্ব দিতে হবে। আর বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির কাছে জমি বিক্রি করলে শতকরা ২০ টাকা হারে রাজস্ব দিতে হবে। এই হিসাব অনুযায়ী শতকরা ২০ টাকা হারে ১ কোটি ১৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু সাধারণ সাব–কবলা দেখিয়ে শতকরা ১২ টাকা হারে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে ৬৯ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকা। ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ টাকার রাজস্ব।

জমির শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে আশুলিয়ার তৎকালীন সাব–রেজিস্ট্রার আবদুল করিম রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে আবদুল করিম কুমিল্লার চান্দিনার রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে কর্মরত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সেসব দলিল নিবন্ধন করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে জেলা নিবন্ধন কর্মকর্তা দীপক কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, শুধু ১৮টি দলিলে নয়, আশুলিয়ার সাবেক সাব–রেজিস্ট্রার আবদুল করিমের বিরুদ্ধে আরও অনেক দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ