মাসে লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন নিয়ে ভিয়েতনামে যান ময়মনসিংহের ত্রিশালের ফরিদুল ইসলাম। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে গত জানুয়ারিতে দেশটিতে পৌঁছান ৩৪ বছর বয়সী ওই যুবক। পৌঁছানোর পর সেখানে থাকা দালালেরা তাঁকে বিক্রি করে দেন চীনের এক ব্যবসায়ীর কাছে।
অভিবাসনের নামে ভিয়েতনামে গিয়ে প্রতারিত হওয়া ও স্বপ্নভঙ্গের এমন কাহিনি আরও অনেক আছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে তাঁরা ভিয়েতনামে যান। কিন্তু যে কোম্পানির চাকরি নিয়ে গেছেন, সেখানে কাজ না দিয়ে বাংলাদেশি একটি দালাল চক্র তাঁদের নিয়ে যান। এরপর তাঁদের সাপ্লাই এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। দেশটির রাজধানী থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে বিভিন্ন এজেন্টের ক্যাম্পে ছিলেন তাঁরা। সেখানে নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। পালিয়ে দালালের কাছে ফিরে এলে তাঁরাও নির্যাতন করেন এবং আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সামনে আশ্রয় নেন তাঁরা।
তবে প্রবাসীদের কয়েকজন মানব পাচার আইনে অনলাইনে মামলা করেছেন। এর মধ্যে ফরিদুল ও মোকছেদুল প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের করা মামলায় স্থানীয় দালাল মোশাররফ ও কাজী সালেহ আহমেদ পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। আর কুমিল্লার রায়হানউদ্দিন বলেন, মঙ্গলবার মামলা করেছেন, দালাল মোজাম্মেল গ্রেপ্তার হননি।
ভিয়েতনামপ্রবাসী ও দেশের অভিবাসন খাত–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ৯৭ জন প্রবাসী কর্মীর কাছ থেকে ভিয়েতনামে চাকরির নামে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এঁদের ১৪ জন ইতিমধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন। দেশে ফিরতে দূতাবাসের সামনে অবস্থান করছিলেন ২২ বাংলাদেশি। চার দিন অবস্থানের পর তাঁদের হোটেলে দেওয়া হয়েছে। আর ৩৯ জন ইতিমধ্যে দুটি হোটেলে আছেন। বাকিরা দেশটির গুনতাও ও হোমেনসিটির আনিয়ুন বিংজুং এলাকার ক্যাম্পে আছেন।
ভিয়েতনামে ১০ বাংলাদেশির চক্র
ভিয়েতনামে ১০ বাংলাদেশির একটি দালাল চক্র খুঁজে পাওয়া গেছে প্রবাসী কর্মীদের কাছ থেকে। দেশ থেকে কর্মীরা গিয়ে ওই দালালের হাতে পড়েন। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। কম টাকায় দুর্গম এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে অমানবিক কাজ করতে বাধ্য করে। এ দালাল চক্রের মূল হচ্ছেন মোস্তফা। তাঁর সঙ্গে কাজ করেন আতিকুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, জাব্বার, মিলন, আকরাম, নাসির, মাসুদ, ইফতেখার ও রায়হান। এর মধ্যে মোস্তফা, সাইফুল ও আতিক সেখানে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বাস করছেন।
এ অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ভিয়েতনামে ব্যবহৃত তাঁদের ফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি মোস্তফা ও সাইফুল।
অভিযোগ ৯ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে
বিএমইটি থেকে ৯৭ জন কর্মীর ছাড়পত্র নেওয়ায় ৯টি রিক্রুটিং এজেন্সির জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে এ ঝর্না ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সন্ধানী ওভারসিজ লিমিটেড, মাম অ্যান্ড মাম ওভারসিজ, মুন এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ইসতেমা ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি, আলিফ ইন্টারন্যাশনাল, এসকে গ্লোবাল ওভারসিজ, রেজওয়ান ওভারসিজ ও হলি ওভারসিজ লিমিটেড।
>দুই দেশেই সক্রিয় দালাল চক্র
৯ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারিত ৯৭ জন
বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে দেশ ছেড়েছেন কর্মীরা
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এ ঝর্না ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্ত দেব সাহা বলেন, ‘আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে অন্যরা পাঠিয়েছে। আমি একটি টাকাও পাইনি। তবু ফেঁসে গেছি। ১১ জন কর্মীর বিষয়ে বিএমইটি চিঠি দিয়েছে। তাদের ক্ষতিপূরণে অঙ্গীকারনামা দিয়ে এসেছি।’
তবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কোনো সমস্যা হলেই দায় আসে রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর, এটা ঠিক নয়। সরকারের সব নিয়মকানুন মেনেই ভিয়েতনামে কর্মী পাঠানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে কাজ পেতে সমস্যা হয়েছে কারও কারও। এটা কোনোভাবেই মানব পাচার নয়।
ভুক্তভোগী কর্মীদের দায় কার
বিদেশে কর্মীরা বিপদে পড়লে এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপায়। বায়রা বলছে, অভিবাসন আইনের সব নিয়ম মেনেই কর্মী পাঠানো হয়েছে। নিয়োগদাতার তথ্য যাচাই করে দূতাবাস। আর সব কাগজপত্র ও তথ্য যাচাই করেই কর্মীর ছাড়পত্র দিয়েছে বিএমইটি।
তবে বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কর্মী কাজ না পেলে দায় এজেন্সির। কাজ দেওয়ার অঙ্গীকার করেই তারা কর্মীর ছাড়পত্র নেয়। ইতিমধ্যে ছয়টি এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া অনিয়মের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।
সার্বিক বিষয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলছেন, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়, রিক্রুটিং এজেন্সি—সবার দায় আছে। পুরোনো শ্রমবাজারের মতো এখানেও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানো হচ্ছে। সবার জবাবদিহি দরকার। কর্মীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ এবং জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ একসঙ্গেই করতে হবে।